বঙ্গভঙ্গ কি? বঙ্গভঙ্গ কত সালে হয়? কত সালে রদ করা হয়?

বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে বঙ্গভঙ্গ একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ইংরেজদের ভাগ কর ও শাসন কর এর আকাঙ্ক্ষা বরাবরই ছিল। এখানে অভিজাত হিন্দুদের প্রতি বঞ্চিত মুসলমানদের মধ্যে যে অবিশ্বাস ছিল সেটাকে কাজে লাগিয়ে বঙ্গভঙ্গ উদ্যোগ নেয় ইংরেজ শাসকেরা। হিন্দুদের বড়ো অংশ বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করে এবং মুসলমানদের বড়ো অংশ বঙ্গভঙ্গকে সমর্থন করে। এই প্রচেষ্টা বিদ্যমান সাম্প্রদায়িক অস্বস্তি ও অবিশ্বাসকে রাজনৈতিকভাবে সামনে নিয়ে আসে।

বঙ্গভঙ্গ কি? বঙ্গভঙ্গের পটভূমি

ভারতের বড় লাট লর্ড কার্জন ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর বাংলা ভাগ করেন। এই বিভক্তি ইতিহাসে বঙ্গভঙ্গ নামে পরিচিত। ভাগ হবার পূর্বে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, মধ্যপ্রদেশ. মেঘালয়, ত্রিপুরা ও আসামের কিছু অংশ নিয়ে গঠিত ছিল বাংলা প্রদেশ বা বাংলা প্রেসিডেন্সি। বঙ্গভঙ্গের এই পরিকল্পনা অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছিলো। বাংলা প্রেসিডেন্সির আয়তন অনেক বড় হওয়ার কারণে ১৮৫৩ থেকে ১৯০৩ সালে বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা গৃহীত হয়। 
বঙ্গভঙ্গ কি? বঙ্গভঙ্গ কত সালে হয়? কত সালে রদ করা হয়?
১৯০৪ সালে ভারত সচিব এটি অনুমোদন করেন এবং ১৯০৫ সালের জুলাই মাসে বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা প্রকাশিত হয়। সে বছর অক্টোবরে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়। এই পরিকল্পনা বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী এবং ভারতের আসাম, জলপাইগুড়ি, পার্বত্য ত্রিপুরা ও মালদহ নিয়ে গঠিত হয় পূর্ব বাংলা ও আসাম নামে নতুন প্রদেশ। প্রদেশের রাজধানী হয় ঢাকা। অপরপক্ষে পশ্চিম বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা নিয়ে গঠিত হয় পশ্চিম বাংলা প্রদেশ, যার রাজধানী হয় কলকাতা।

বঙ্গভঙ্গের কারণ

বঙ্গভঙ্গের পেছনে বেশ কিছু কারণ ছিল, যা নিচে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলোঃ

১। প্রশাসনিক কারণ

২। আর্থ-সামাজিক কারণ

৩। রাজনৈতিক কারণ ইত্যাদি।

প্রশাসনিক কারণ: লর্ড কার্জনের শাসনামলে বঙ্গভঙ্গ ছিল একটি প্রশাসনিক সংস্কার। উপমহাদেশের এক তৃতীয়াংশ লোকের বসবাস ছিল বাংলা প্রেসিডেন্সিতে। কলকাতা থেকে বাংলার পূর্বাংশের আইনশৃঙ্খা রক্ষা ও শাসনকার্য সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা ছিল কঠিন কাজ। যে কারণে লর্জ কার্জন গোটা বাংলা অঞ্চলকে একটি প্রশাসনিক ইউনিটে রাখা যুক্তিসংগত মনে করেননি। তাই ১৯০৩ সালে বাংলা প্রদেশকে ভাগ করার পরিকল্পনা করেন এবং ১৯০৫ সালে তা কার্যকর হয়।

আর্থ-সামাজিক কারণ: বাংলা ভাগের পেছনে আরো কারণ ছিল যার একটি অর্থনৈতিক, অপরটি সামাজিক। তখন কলকাতা হয়ে উঠেছিলো আর্থ-সামাজিক কর্মকান্ডের প্রাণকেন্দ্র। শিল্প, কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সবকিছুই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো কলকাতাকে কেন্দ্র করে। যা কিছু উন্নতি, অগ্রগতি সবই ছিল কলকাতার মধ্যে সীমাবদ্ধ। 
ফলে পূর্ব বাংলার উন্নতি ব্যাহত হয়। অথচ এখান থেকে কাঁচামাল সরবরাহ করা হতো তার জন্যও সুষ্ঠু যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না। ফলে পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা ক্রমেই খারাপ হতে থাকে। উপযুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাবে শিক্ষা, উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে না পারায় এলাকার লোকজন অশিক্ষিত থেকে যায়। কর্মহীনের সংখ্যা দিন দিন বেড় যেতে থাকে। এ অবস্থার কথা বিবেচনা করে বঙ্গভঙ্গের প্রয়োজন ছিল বলে অনেকেই মনে করেন।

রাজনৈতিক কারণ: লর্ড কার্জন শুধু শাসন-সুবিধার জন্য বা পূর্ব বাংলার জনগণের কল্যাণের কথা বিবেচনা করে বঙ্গভঙ্গ করেননি। এর পেছনে ব্রিটিশ প্রশাসনের সদূরপ্রসারী রাজনৈতিক স্বার্থও জড়িত ছিল। লর্ড কার্জন বাংলার রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। বাঙালি মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবি শ্রেণি ক্রমশ জাতীয়তাবাদ ও রাজনীতি সচেতন হয়ে উঠেছিলো। বিষয়টি তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি। কংগ্রেস নেতারা কলকাতা থেকেই সারা ভারতের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতেন। 

সুতরাং কলকাতাকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থামিয়ে দেওয়া ছিল এর মূল উদ্দেশ্য। হিন্দু ও মুসলমান সম্মিলিত শক্তির ঐক্যবদ্ধ বাংলা ছিল ব্রিটিশ প্রশাসনের জন্য বিপজ্জনক। ফলে বাংলা ভাগ করে একদিকে বাঙালির শক্তিকে দুর্বল করা হলো, অপরদিকে শাসন নীতি প্রয়োগ করে যতটা না পূর্ব বাংলার কল্যাণে, তার চেয়ে বেশি ব্রিটিশ ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে বাংলা ভাগ করেন। এভাবে কৌশলে ভারতীয় ঐক্যকে দুর্বল করার ব্যবস্থা করা হলো।

বঙ্গভঙ্গ কত সালে হয়?

বঙ্গভঙ্গ ১৯০৫ সালে হয়।

বঙ্গভঙ্গের প্রতিক্রয়া

বঙ্গভঙ্গ ঘোষণার ফলে বাংলার মানুষের মধ্য মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। পূর্ব বাংলার মুসলমানরা নবাব সলিমুল্লার নেতৃত্বে বঙ্গভঙ্গকে স্বাগত জানায়। মুসলিম পত্র-পত্রিকাগুলো বঙ্গ বিভাগে সন্তোষ প্রকাশ করে। সুতরাং ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পূর্ব বাংলার পিছিয়ে পড়া মানুষেরা শিক্ষা-দীক্ষা এবং প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা লাভের আশায় বঙ্গভঙ্গের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন প্রদান করে।

অপরদিকে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায় উচ্চবর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে। এর পেছনের কারণ সম্পর্কে কোনো কোনো ঐতিহাসিক বলেছেন উঁচুতলার মানুষ অর্থাৎ পুঁজিপতি, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, জমিদার, আইনজীবি, সংবাদপত্রের মালিক, রাজনীতিবিদদের স্বার্থে আঘাত লাগার কারণে এরা বঙ্গভঙ্গের ঘোর বিরোধিতা শুরু করে। এই আন্দোলনে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, বিপিনচন্দ্র পাল, অরবিন্দ ঘোষ, অশ্বিনীকুমার দত্ত, বালগঙ্গাধর তিলকসহ গোখলের মতো উদারপন্থী নেতাও অংশ নেন। 
আরো পড়ুন: দ্বৈত শাসন কি?
সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি বঙ্গভঙ্গকে জাতীয় দুর্যোগ বলে আখ্যায়িত করেন। অন্যদিকে অভিজাত মুসলমান নেতৃবৃন্দের মধ্যে ও নবাব সলিমুল্লাহর সৎ ভাই খাজা আতিকুল্লাহ, আব্দুর রসূল, খান বাহাদুর মোঃ ইউসুফ, আব্দুল হালিম গজনবী, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, মুহাম্মাদ গোলাম হোসেন, মৌলবী লিয়াকত হোসেন, সৈয়দ হাফিজুর রহমান চৌধুরি, আবুল কাশেমসহ অনেকেই বঙ্গভঙ্গ বিরোধী কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেন। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন ক্রমে স্বদেশী আন্দোলনে রূপ নেয়। চরমপন্থী নেতার কারণে এই আন্দোলনের সঙ্গে সশস্ত্র কার্যকলাপও যুক্ত হয়। ব্রিটিশ সরকার আন্দোলনকারীদের দমন করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত রাজা পঞ্চম জর্জ ভারত সফরে এসে ১৯১১ সালে দিল্লির দরবারে বঙ্গভঙ্গ রদের ঘোষণা দেন।

বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে উভয় ধর্মের অবিজাত শ্রেণির একাংশ মনে করে এটি তাদের জয়। কিন্তু ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ বঙ্গভঙ্গ রদে মর্মহত হয়। বিট্রিশ সরকার ও অভিজাত নেতৃবৃন্দের প্রতি তাদের আস্থা নষ্ট হয়ে উদারবাদী নেতৃবৃ্ন্দ একে ব্রিটিশ সরকারের কুট রাজনীতির উদাহারণ বলে মনে করেন। বঙ্গভঙ্গের পর থেকে হাজার বছরের হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের অবনতি হতে থাকে।

বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয় কত সালে?

বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয় ১৯১১ সালে।

উপসংহার

প্রিয় পাঠক, আজকে আমি আপনাদের সাথে বঙ্গভঙ্গ কি? বঙ্গভঙ্গ কত সালে হয়? কত সালে রদ করা হয়? এগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। আশা করি আপনি এই পোস্টটি পুরো মনোযোগ সহকারে পড়েছেন এবং উপকৃত হতে পেরেছেন। এই রকম ইতিহাস তথ্য মূলক পোস্ট পড়তে আমাদের সাথেই থাকুন। প্রিয় পাঠক, এই পোস্টটি পুরো মনোযোগ সহকারে পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url