চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কি? বিস্তারিত জেনে নিন
প্রিয় পাঠক, আজকে আমি আপনাদের সাথে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কি এই টপিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো। আশা করি আপনি এই পোস্টটি পুরো মনোযোগ সহকারে পড়বেন। আপনি যদি এই পোস্টটি পুরো মনোযোগ সহকারে পড়েন তাহলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কি তা বিস্তারিত জানতে পারবেন। প্রিয় পাঠক, চলুন বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ভারতের উপমহাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এটি ছিল একটি ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা, যা মূলত ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দ্বারা প্রবর্তিত হয়। ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিসের নেতৃত্বে এই ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল, যা মূলত বাংলার জন্য প্রযোজ্য ছিল। এই বন্দোবস্তটি ভারতীয় সমাজ, অর্থনীতি এবং রাজনীতিতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিল।
এই নীতির মূল লক্ষ্য ছিল কৃষি থেকে রাজস্ব নিশ্চিত করা এবং একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীকে ব্রিটিশ শাসনের প্রতি বিশ্বস্ত রাখা। কিন্তু এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ছিল ভারতীয় কৃষক সমাজের উপর অত্যন্ত কঠিন। এ প্রবন্ধে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ইতিহাস, বৈশিষ্ট্য, প্রভাব এবং এর সমালোচনা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হবে।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কি?
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হল ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে প্রবর্তিত একটি ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা, যেখানে জমিদারদের নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব স্থায়ীভাবে নির্ধারণ করা হয়। এই ব্যবস্থা অনুযায়ী, জমিদাররা তাদের জমির উপর স্থায়ী অধিকার লাভ করে এবং সরকারের কাছে নির্দিষ্ট রাজস্ব প্রদান করতে বাধ্য থাকে। রাজস্ব একবার নির্ধারণ করা হলে তা স্থায়ীভাবে অপরিবর্তনীয় থাকত, অর্থাৎ কৃষি উৎপাদন বাড়লেও রাজস্বের হার বাড়ানো যেত না।
আরো পড়ুন: চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কি
এই বন্দোবস্তের মাধ্যমে জমিদাররা একটি প্রভু শ্রেণীতে পরিণত হয়। তারা কৃষকদের কাছ থেকে কর সংগ্রহ করত এবং সরকারের কাছে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদান করত। এই ব্যবস্থাটি মূলত বাংলার জন্য প্রবর্তিত হলেও পরে বিহার, উড়িষ্যা এবং উত্তর ভারতের কিছু অংশেও এটি কার্যকর করা হয়।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত পটভূমি
১৯৭২ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস রাজস্ব আদায়ের জন্য পাঁচসালা বন্দোবস্ত চালু করেন। এই ব্যবস্থায় উচ্চহারে ডাক নিয়ে জমির বন্দোবস্ত নিলেও সেই অনুপাতে রাজস্ব আদায় হতো না। নির্দিষ্ট সময়সীমা থাকায় জমিদাররা কৃষকদের কাছ থেকে প্রয়োজনে নির্যাতন করে অর্থ আদায় করত। অথচ কৃষকদের উন্নয়ন বা জমির উন্নয়নের প্রতি তাদের কোনো লক্ষ ছিল না। ফলে নির্যাতনের ভয়ে কৃষকরা জমি ছেড়ে পালিয়ে যেত। বছরের পর বছর জমি অনাবাদি থাকায় জমির দাম কমে যেত।
এ অবস্থায় হেস্টিংস জমিদারদের সঙ্গে একসালা বন্দোবস্ত চালু করেন। কিন্তু, এ ব্যবস্থায়ও সরকার, জমিদার, প্রজা-কারো কোনো ধরনের উপকার হয়নি। পরবর্তীকালে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার রাজস্ব সমস্যা সমাধানের জন্য ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট নতুন ব্যবস্থা উদ্ভাবনের প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি করে। ১৭৮৪ সালে পিটের ইন্ডিয়া অ্যাক্ট পার্লামেন্টে গৃহীত হয়। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যায় স্থায়ী নিয়ম-কানুন প্রবর্তনের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি রাজস্ব ব্যবস্থা চালুর জন্য কোম্পানিকে নির্দেশ দেয়া হয়।
১৭৮৯ সালে কর্নওয়ালিস জমিদারদের দশসালা বন্দোবস্ত দিতে প্রস্তুতি নেন। ইংল্যান্ডের কর্তৃপক্ষ জমিদারদের সঙ্গে বন্দোবস্তের অনুমতি প্রদান করলে কর্নওয়ালিস এই অনুমোদনের পরিপ্রেক্ষিত ১৭৮৯ সালে দশসালা বন্দোবস্ত চালু করেন। তবে এর সঙ্গে এই প্রতিশ্রুতিও তিনি দেন যে, কোম্পানির ডাইরেষ্টর সভার অনুমোদন পেলে দশসালা বন্দোবস্তই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে পরিণত হবে।
১৯৯২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এই দশসালা বন্দোবস্ত বোর্ড অব ডাইরেষ্টরস কর্তৃক অনুমোদন লাভ করে। ১৭৯৩ সালের ২২ শে মার্চ কর্নওয়ালিস দশসালা বন্দোবস্তকে চিরস্থায়ী বলে ঘোষণা করেন।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বৈশিষ্ট্য
- চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত জমিদারদের জমির স্থায়ী মালিকে পরিণত করে এবং জমিদাররা জমির মালিকানা স্বত্ব লাভ করে।
- রাজস্বের পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দেওয়ার ফলে নিয়মিত রাজস্ব প্রদানের বিনিময়ে জমিদার জমিদারি ভোগের চিরস্থায়ী অধিকার লাভ করে।
- এ প্রথা চালু হওয়ার ফলে জমিদারদের প্রশাসনিক ক্ষমতা বিলুপ্ত হয়। সরকার স্বয়ং শান্তি রক্ষা ও নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণ করে।
- খাজনা বাকি পড়লে জমিদারদের ভূমির কিছু অংশ বিক্রি করে রাজস্ব আদায় করার ব্যবস্থা ছিল।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ফলাফল
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাংলার আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোয় সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। কর্নওয়ালিস জমিদার ছিলেন। তিনি ইংল্যান্ডের মতো এদেশেও একটি জমিদার শ্রেণি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ইউরোপ আর উপমহাদেশের আর্থ-সামাজিক কাঠামো ও তার বিকাশের ধরণ এক ছিল না। ফলে বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া এ ব্যবস্থায় সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই অধিক পরিলক্ষিত হয়।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সুবিধা
- এ ব্যবস্থার প্রধান সুবিধা হচ্ছে সরকার তার আয়ের পরিমাণ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়। এ কারণে বাজেট প্রণয়ন, বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সরকারের পক্ষে সহজ হয়।
- চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সৃষ্ট জমিদার শ্রেণি কোম্পানির একনিষ্ঠ সমর্থক হয়ে ওঠে। ফলে, ব্রিটিশ শাসন দৃঢ়করণ এবং দীর্ঘায়িতকরণে জমিদাররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়।
- জমির ওপর জমিদারের স্থায়ী মালিকানা স্বীকৃত হওয়ার কারণে অনেকেই নিজ নিজ এলাকায় নানা জনকল্যাণমূলক কাজে ব্রতী হয়। জঙ্গলাকীর্ণ জমি চাষের ব্যবস্থা করে। ফলে উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয়।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ক্রটি
- চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমিদারের স্বার্থ সুরক্ষিত হয়। তারা ধীরে ধীরে ধনিক শ্রেণিতে পরিণত হয়। অপর দিকে জমিতে প্রজাদের পুরোনো স্বত্ব সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়। ফলে জমিদার ইচ্ছে করলেই যেকোনো সময় তাদের জমি থেকে উচ্ছেদ করতে পারতো। প্রথম দিকে প্রজাস্বত্ব আইন না থাকায় তাদের ভাগ্যের জন্য সম্পূর্ণভাবে জমিদারের দয়ার ওপর নির্ভর করতে হতো।
- চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে জমির সঠিক জরিপের ব্যবস্থা না থাকায় অনেক সময় নিষ্কর জমির ওপর বেশি রাজস্ব ধার্য করা হতো। জমির সীমা নির্ধারিত না থাকায় পরবর্তীকালে মামলা বিবাদও দেখা দিত।
- সূর্যাস্ত আইনে নির্দিষ্ট তারিখে সূর্যাস্তের মধ্যে খাজনা পরিশোধ বিধানের কঠোরতার কারণে অনেক বড় বড় জমিদারি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
- জমিদারি আয় ও স্বত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে জমিদাররা নায়েব-গোমস্তার ওপর দায়িত্ব দিয়ে শহরে বসবাস শুরু করে। এসব অনুপস্থিত জমিদারদের নায়েব-গোমস্তাদের অত্যাচারে প্রজারা অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। ফলে জমির উৎপাদন কমে যেতে থাকে, গ্রামের অর্থনৈতিক অবস্থাও খারাপ হতে থাকে।
- উপমাহাদেশে জমি ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। ফলে নিম্নবর্গের অনেক ব্যক্তি, সাধারণ মানুষ যারা কোম্পানির সঙ্গে ব্যবসায়-বাণিজ্য করে প্রচুর অর্থের মালিক হন, তারা জমিদারি কিনে আভিজাত্যের মর্যাদা লাভে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। ফলে দেশীয় পুঁজি, দেশীয় শিল্প গড়ে ওঠার সম্ভাবনা ধ্বংস হয়ে যায়। অপর দিকে কোম্পানিও সম্ভাব্য এদেশীয় প্রতিদ্বন্ধীর হাত থেকে বেঁচে যায়।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে কৃষকরা সরাসরি, জমিদার কর্তৃক শোষিত হতে থাকে। আবার এই জমিদার শ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে গ্রামীন সমাজে একটি শিক্ষিত শ্রেণি গড়ে উঠছিল, যারা পরবর্তী সময়ে দেশ জাতি সম্পের্কে সচেতন হয়ে ওঠে। একই সঙ্গে ব্রিটিশ কর্তৃক সৃষ্ট জমিদার শ্রেণি যারা প্রথমদিকে ব্রিটিশ সম্রাজ্যের শক্ত ভিত ছিল, তাদেরই পরবর্তী প্রজন্ম পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ব্রিটিশ-রাজ উৎখাতের জন্য স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। উপমহাদেশে জাতীয়বাদ বিকশিত এভাবেই হয়।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাতিল করা হয় কত সালে
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পূর্ণরূপে বাতিল করা হয় ভারতের স্বাধীনতার পর। ১৯৫১ সালে ভারতের প্রথম ভূমি সংস্কার আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এই ব্যবস্থার অবসান শুরু হয়। স্বাধীনতার পর ভারত সরকার কৃষি সংস্কারের ওপর জোর দেয় এবং জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত করার জন্য বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করে। বিশেষভাবে, ১৯৫০-এর দশকের শুরুতে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, এবং উড়িষ্যা সহ বিভিন্ন রাজ্যে জমিদারি বিলুপ্তি আইন কার্যকর করা হয়।
এই আইনের অধীনে জমিদারদের থেকে জমির মালিকানা সরিয়ে সরাসরি কৃষকদের হাতে দেওয়া হয়। এর ফলে জমির প্রকৃত চাষীরা সরাসরি মালিকানা লাভ করে এবং ব্রিটিশদের তৈরি করা জমিদারি প্রথার আনুষ্ঠানিক অবসান ঘটে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে সরকার কৃষকদের আর্থ-সামাজিক উন্নতি নিশ্চিত করার চেষ্টা করে এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস করার পদক্ষেপ নেয়।
উপসংহার
প্রিয় পাঠক, আজকে আমি আপনাদের সাথে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কি এই টপিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। আশা করি আপনি এই পোস্টটি পুরো মনোযোগ সহকারে পড়েছেন এবং উপকৃত হতে পেরেছেন। এ রকম আরো তথ্য মূলক পোস্ট পড়তে আমাদের সাথেই থাকুন। আমরা সবসসয় পাঠকের চাহিদা অনুযায়ী পোস্ট পাবলিশ করে থাকি। এই পোস্টটি পুরো মনোযোগ সহকারে পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url