পলাশির যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল জেনে নিন

১৭৪০ থেকে ১৭৫৬ সাল পর্যন্ত আলীবর্দি খান বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাব ছিলেন। প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও তিনি সফলভাবে রাজ্য শাসন করেছেন। তিনি তাঁর সময়ে মারাঠা ও বর্গিদের দমন করে রাখতে সক্ষম হন। সুকৌশলে ইংরেজ বণিক কোম্পানিকেও নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর বাংলার রাজনীতিতে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। নবাব মৃত্যেুর আগে তার কনিষ্ঠ কন্যা আমেনা বেগমের পুত্র সিরাজউদ্দৌলাকে বাংলার সিংহাসনের উত্তরাধিকার মনোনীত করে যান। ১৭৫৬ সালে আলীবর্দি খানের মৃত্যু হলে তাঁর প্রিয় দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলা মাত্র ২২ বছর বয়সে নবাবের ক্ষমতা গ্রহণ করেন।
পলাশির যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল জেনে নিন
সিংহাসনে বসার পর থেকে তাঁকে নানামুখী ষড়যন্ত্র ও সমস্যার মোকাবেলা করতে হয়। তাঁর প্রথম সমস্যা ছিল পরিবারের ঘনিষ্ঠজনের ষড়যন্ত্র। বিশেষ করে আলিবর্দি খানের তিন কন্যার মধ্য জ্যেষ্ঠ কন্যা ঘসেটি বেগম সিরাজ নবাব হওয়ায় আশাহত হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। এদের সঙ্গে যোগ দেন ঘসেটি বেগমের দেওয়ান রাজা রাজবল্লভ, পূর্ণিয়ার শাসনকর্তা সিরাজের খালাতো ভাই শওকত জঙ্গ এবং অন্যরা। কৌশলে নবাব ঘসেটি বেগমকে নজরবন্দি করেন। পূর্ণিয়ার শাসনকর্তা শওকত জঙ্গ বিদ্রোহী হয়ে উঠলে সিরাজেউদ্দৌলা এক যুদ্ধে তাকে পরাজিত ও নিহত করে পূর্ণিয়া দখল করে নেন।

নবাব পারিবারিক ষড়যন্ত্র কৌশলে দমন করলেও তাঁর বিরুদ্ধে বাইরে ষড়যন্ত্রের আরেক জাল বিস্তৃত হতে থাকে। এর সঙ্গে জড়িত হয় দেশি-বিদেশি বণিক শ্রেণি, নবাবের দরবারের প্রভাবশালী রাজন্যবর্গ ও অভিজাত শ্রেণি, নবাবের সেনাপতি মীর জাফরসহ আরো অনেকে। প্রত্যেকে নিজ স্বার্থ উদ্ধারের জন্য নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। এই ষড়যন্ত্রকারীরা পলাশি যুদ্ধের পটভূমি তৈরি করতে থাকে।

পলাশি যুদ্ধের কারণ

ইতিহাসের যেসব ঘটনা একটি দেশের জনগণের ভাগ্যে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটাতে পারে, পলাশির যুদ্ধ এ অঞ্চলের জনগণের জন্য তেমনি এক ঘটনা ছিল। এই ঘটনার পেছনে কারণগুলো নিম্নে উল্লেখ করা হলোঃ

১। সিরাজউদ্দৌলা বাংলার সিংহাসনে বসার পর প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী ইংরেজরা নতুন নবাবকে কোনো উপঢৌকন পাঠায়নি এবং তাঁর সঙ্গে কোনো সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎও করেনি। ইংরেজদের এই অসৌজন্যমূলক আচরণে নবাব ক্ষুব্ধ হন।

২। নবাবের নিষেধাজ্ঞা সত্বেও তারা কলকাতায় দুর্গ নির্মাণ অব্যাহত রাখে।

৩। ইংরেজ কোম্পানি দস্তকের অপব্যবহার করলে দেশীয় বণিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকেন। নবাব দস্তকের অপব্যবহার করতে নিষেধ করেন এবং বাণিজ্যিক শর্ত মেনে চলার আদেশ দেন। কোম্পানি নবাবের সে আদেশও অগ্রাসহ্য করে।

৪। আলিবর্দি খানের সঙ্গে চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে ইংরেজরা নবাবকে কর দিতে অস্বীকৃতি জানায়। তাছাড়া জনগণকে নির্যাতন করার মতো ধৃষ্টতাও তারা দেখাতে থাকে।

৫। রাজা রাজবল্লভের পুত্র কৃষ্ণদাস তার পরিবারের সদস্যদের সহ প্রচুর ধনসম্পদ নিয়ে কলকাতায় ইংরেজদের কাছে আশ্রয় নেন। তাকে ফেরত দেয়ার জন্য নবাব ইংরেজদের নিকট দূত পাঠান। ইংরেজ নভর্নর নবাবের দূতকে অপমান করে তাড়িয়ে দেন। এ আগে শওকত জঙ্গের বিদ্রোহের সময়ও ইংরেজরা নবাবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের সমর্থন দেন। ইত্যাদি এসব কারণেই পলাশির যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিলো।
ইংরেজদের একের পর এক ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ ও অবাধ্যতা নবাবকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। তাদের উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়ার জন্য ১৭৫৭ সালের জুন মাসের শুরুতে নবাব কোলকাতা অধিকার করে নেন। যাত্রাপথে তিনি কাশিম বাজার কুঠিও দখল করেন। নবাবের অতর্কিত আক্রমণে ইংরেজরা ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ ত্যাগ করে পালিয়ে যায়। হলওয়েলসহ বেশ কিছু ইংরেজ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে নবাবকে হেয় করার জন্য হলওয়েল এক মিথ্যা প্রচারণা চালায়, যা ইতিহাসে অন্ধকূপ হত্যা নামে পরিচিত। 

এতে বলা হয় যে, ১৮ ফুট দৈর্ঘ্য ১৪,১০ ফুট প্রস্থ ছোট একটি ঘরে ১৪৬ জন ইংরেজকে বন্দি রাখা হয়। এতে প্রচণ্ড গরমে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে ১২৩ জনের মৃত্যু হয়। এই মিথ্যা প্রচার মাদ্রাজ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। ফলে উত্তেজিত হয়ে কলকাতা দখল করার জন্য ওয়াটসন ও ক্লাইভ মাদ্রাজ থেকে কলকাতায় চলে আসে। তারা নবাবের সেনাপতি মানিকচাঁদকে পরাজিত করে কলকাতা দখল করে নেয়। নবাব তাঁর চারদিকে ষড়যন্ত্র ও শত্রু পরিবেষ্টিত হয়ে ইংরেজদের সঙ্গে নতজানু ও অপমানজনক সন্ধি করতে বাধ্য হন। এটি ইতিহাসে আলীনগর সন্ধী নামে খ্যাত।

আলীনগর সন্ধিতে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার পর ক্লাইভের উচ্চাকাঙ্খা আরো বৃদ্ধি পায়। নবাবের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ইউরোপে সংঘটিত সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধের অজুহাতে ইংরেজরা ফরাসিদের চন্দননগুর কুঠি দখল করে নেয়। নবাব এ অবস্থায় ফরাসিদের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করে ইংরেজদের শায়েস্তা করার ব্যবস্থা নেন। এতে ক্লাইভ ক্ষুব্ধ হয়ে নবাবকে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এই ষড়যন্ত্রে ক্লাইভের সঙ্গে যুক্ত হয় জগৎ শেঠ, রায়দুর্লভ, উমিচাঁদ রাজা, রায়বল্লভ প্রধান সেনাপতি প্রমুখ।

পলাশির যুদ্ধর ঘটনা

পলাশির যুদ্ধ বাংলা তথা এ উপমহাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন ভাগীরথী-নদীর তীরে পলাশির আমবাগানে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ইতোমধ্যে রবার্ট ক্লাইভ তার অবস্থান সুদৃঢ় করে সন্ধি ভঙ্গের অজুহাতে সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। নবাবের পক্ষে দেশপ্রেমিক মীর মদন, মোহন লাল এবং ফরাসি সেনাপতি সিন ফ্রে প্রাণপণ যুদ্ধ করেন। যুদ্ধে মীর মদন নিহত হন। নবাবের বিজয় আসন্ন জেনে মীর জাফর ষড়যন্ত্রমূলকভাবে যুদ্ধ থামিয়ে দেয়। 
মীর মদনের মৃত্যু ও মীর জাফরের অসহযোগিতা নবাবকে বিচলিত করে। নবাবের সেনাপতি মীর জাফর যুদ্ধক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অসহযোগিতা করে নীরব দর্শকের ভূমিকায় ছিল। নবাব কোরআন স্পর্শ করিয়ে শপথ নেয়ালেও মীর জাফরের ষড়যন্ত্র থামেনি। নবাবের সৈন্যরা যখন বিশ্রাম নিচ্ছে, সেই সময় মীর জাফরের ইঙ্গিতে ইংরেজ সৈন্যরা তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। যার অনিবার্য পরিণতি নবাবের পরাজয়।

নবাবের পতনের কারণ

  • নবাবের সেনাপতি মীর জাফর ও তার সহযোগিদের যুদ্ধক্ষেত্রে অসহযোগিতা ও বিশ্বাসঘাতকতা।
  • নবাবের সেনাপতি থেকে সভাসদ অধিকাংশই দেশের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে, ব্যক্তিস্বার্থকে বড় করে দেখেছে।
  • তরুণ নবাবের অভিজ্ঞতা, দূরদর্শিতা, বিচক্ষণতা ও দৃঢ়তার অভাব ছিল। তিন যুদ্ধক্ষেত্রে দ্রুত সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থতার পরিচয় দেন।
  • সেনাপতি মীর জাফরের ষড়যন্ত্রের কথা জানা সত্বেও তিনি বার বার তার ওপরই বিশ্বাস করেছিলেন এবং নির্ভর করেছিলেন।
  • ইংরেজদের সম্পর্কে সতর্কতা, ফরাসি এবং ইংরেজদের ষড়যন্ত্র-এসব বিষয়ে আলিবির্দ খানের উপদেশ সিরাজউদ্দৌলার কাছে গুরুত্ব পায়নি।
  • জগৎ শেখ, রায়দুর্লভ অন্যান্য অভিজাত চক্রের বিশ্বাসঘাতকতা।
  • রবার্ট ক্লাইভ ছিল দূরদর্শী, সূক্ষ্ম ও কুটবুদ্ধিসম্পন্ন।

পলাশি যুদ্ধের ফলাফল

  1. সিরাজউদ্দৌলা পরাজয় ও মৃ্ত্যু বাংলায় মুঘল শাসনের অবসান ঘটায় এবং ঔপনিবেশিক শাসনের পথ সুগম হয়।
  2. যুদ্ধের ফলে ইংরেজরা মীর জাফরকে বাংলার সিংহাসনে বসালেও তিনি ছিলেন নামেমাত্র নবাব, প্রকৃত ক্ষমতা ছিল রবার্ট ক্লাইভের হাতে।
  3. পলাশির যুদ্ধের ফলে ইংরেজরা বাংলায় একচেটিয়া ব্যবসায়-বাণিজ্যের অধিকার লাভ করে। ফরাসিরা এদেশ থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হয়।
  4. এ যুদ্ধের পর ইংরেজ শক্তির স্বার্থে এদেশের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক পরিবর্তন হতে থাকে।
  5. পলাশির যুদ্ধের সুদূরপ্রসারী পরিণতি ছিল উপমহাদেশে কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠা এবং এভাবেই এ যুদ্ধের ফলে বাংলা তথা ভারতের স্বাধীনতা অস্তমিত হয়।

উপসংহার

প্রিয় পাঠক, আজকে আমি আপনাদের সাথে পলাশির যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল এই টপিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। আশা করি আপনি এই পোস্টটি পুরো মনোযোগ সহকারে পড়েছেন এবং উপকৃত হতে পেরেছেন। এ রকম আরো তথ্য মূলক পোস্ট পড়তে আমাদের সাথেই থাকুন। প্রিয় পাঠক, এই পোস্টটি পুরো মনোযোগ সহকারে পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url