মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ভূমিকা

মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ভূমিকা

ভূমিকা: ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গণমাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গণমাধ্যমকে একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের দ্বিতীয় ফ্রন্ট বলেলেও অত্যুক্তি হবে না। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণে দিশেহারা, শোকাকুল, কামানোর গোলায় পুলিশ লাইন ভস্মীভূত এবং যখন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর এর কিছু বঙ্গশার্দূল স্ব স্ব দায়িত্বে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন প্রতিরোধ সংগ্রামে, ঠিক তখনই জন্ম নেয় বাংলাদেশের স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র। এছাড়াও অন্যান্য গণমাধ্যমেও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের অবস্থা গুরুত্ব সহকারে প্রচার করেছিলো।
মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ভূমিকা
স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র: ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের পর চট্টগ্রাম বেতারের দশজন কর্মীর প্রচেষ্টার ফলে কালুঘাট ট্রান্সমিটারে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র চালু করা হয়। ১৯৭১ সালে ২৬ মার্চ নামকরণ ও পরিকল্পনা সহকারে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের উদ্বোধনী অধিবেশন সম্প্রচারিত হয়। চট্টগ্রামের কালুরঘাট ট্রান্সমিটারে সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে আবুল কাশেম সন্দ্বীপের কণ্ঠে প্রচারিত হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি। এরপর থেকে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।
১। স্বাধীনতা ঘোষণা: ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। এ ঘোষণার মাধ্যমে সর্বজনীন স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। প্রতিদিন সকাল নয়টার পর প্রথম অধিবেশন, দুপুর একটার পর দ্বিতীয় অধিবেশন ও সন্ধ্যা সাতটার পর তৃতীয় অধিবেশন হতো।

২। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অনুষ্ঠান সম্প্রচার: স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে বিভিন্ন ধরনের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অনুষ্ঠান পরিচালনা করা হতো। এ অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে ছিল পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধের আহ্বান, মুক্তিবাহিনীর সাময়িক অগ্রাভিযানের খবর, দিক নির্দেশনামূলক বিভিন্ন বক্তব্য, কথিকা, চরমপত্র প্রভৃতি।

৩। আগরতলা ও রামগড়ের সীমান্তবর্তী এলাকাভিত্তিক বেতারকেন্দ্র: ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ হানাদার বাহিনীর বোমা বর্ষনের ফলে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। ৩ এপ্রিল ১৯৭১ সালে রামগড়ের সীমান্তবর্তী অঞ্চল থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দ্বিতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠান প্রচার শুরু হয়। এখান থেকে প্রতিদিন দুটি অধিবেশন হতো। সকাল আটটা থেকে সাড়ে নয়টা এবং সন্ধ্যা সাতটা থেকে দশটা।

এ বেতার কেন্দ্র থেকে যুদ্ধের খবরাখবর সম্প্রচার করা হতো। পূর্বেকার সংগৃহীত বাংলাদেশে রেকর্ডকৃত গ্রামোফোন রেকর্ডের গান বাজানো হতো এছাড়াও বিমান হামলার সময় করণীয় সম্পর্কিত বিজ্ঞপ্তি জানানো হতো। আরো ছিল বিভিন্ন বিষয়ে তাৎক্ষনিক কথিকা ও কবিতা।

৪। মুজিব নগরের বেতারকেন্দ্র: ১৯৭১ সালে ১০ এপ্রিল মুজিবনগরের অস্থায়ী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধের প্রচার জোরদার করার উদ্দেশ্যে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রকে নতুন করে আবার গঠন করা হয়। রাজশাহী বেতারের অনুষ্ঠান সংগঠক শামসুল হুদা চৌধুরী, ঢাকা বেতারের অনুষ্ঠান সংগঠক আশফাকুর রহমান, এম আর আখতার মুকুল, পটুয়া কামরুল হাসান, তাহের সুলতান এবং আরো ৫০ কিলোওয়াট ট্রান্সমিটারের অনুষ্ঠান শুরু করার প্রস্তুতি পর্বে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। মূলত স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিল সাংগঠনিকভাবে মজবুত প্রচারাভিযান। এ কেন্দ্র থেকে নিম্নোক্ত অনুষ্ঠানগুলো সম্প্রচার করা হতো।

৫। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গান ও কবিতা সম্প্রচার: স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র মুজিবনগরে সমাবেশ ঘটেছিলো সর্বস্তরের বেতারকর্মী, নৈমিত্তিক কথক এবং শিল্পীদের। বাংলাদেশের খ্যাতনামা ব্যক্তিরা এসেছিলেন সীমান্ত পেরিয়ে। সীমিত হলেও এছাড়া গৌরিপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি শিল্পী অংশুমান রায়ের কণ্ঠে এ গানটি প্রচারিত হতো এবং গোবিন্দ হালদারের লেখা মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা, পূর্বে দিগন্তে সূর্য উঠেছে সম্প্রচারিত হতো।

৬। বাংলাদেশের জনগণের করণীয় সম্পর্কে অবহিত করণ: এ বেতারকেন্দ্র থেকে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশিদের করণীয় দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করে তাদেরকে স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত করার জন্য বিভিন্ন অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হতো। এখানে বলা হয় যে, বাঙালিকে সকল শোক বেদনা ভুলে শত্রুকে কঠোর হস্তে দমন করতে হবে।

৭। চরমপত্র প্রকাশ: এম, আর. আখতার মুকুলের চরমপত্র ছিল স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে প্রচারিত সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। ১৯৭১ এ প্রচারিত এ অনুষ্ঠানে বলা হয়, মেজিক কারবার। ঢাকায় তখন মেজিক কারবার চলতেছে। চা রোমুডার থনে গাবুর বাড়ি আর কেচকা মাইর খাইয়া ভোমা ভোমা সাইজের মছুয়া সোলজারগুলো তেজগাঁও কুর্মিটোলায় আইস্যা আ-আ-আ দম ফেলাইতেছে। আর সামনে হিসাবপত্র তৈরি হইতাছে। এ রকম আরো অনেক রসাত্মক বাক্য এ চরমপত্রে ছিল, যা মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ জনগণের মধ্যে অনুপ্রেরণা যোগায়।
এছাড়াও স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে জল্লাদের দরবার, পিন্ডির প্রলাপ, প্রতিনিধির কণ্ঠ, সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি প্রচার করা হতো এবং বিশ্ব জনমত গঠন ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সমর্থন দেওয়ার জন্যও আহ্বান করা হতো।

৮। সংবাদপত্রের ভূমিকা: ১৯৭১ সালে পাকিস্তান দখলদার বাহিনী ২৫ মার্চের পর বাংলাদেশের পত্রিকাগুলোকে অন্যায়ভাবে নিষিদ্ধ করে। তারপরও অঞ্চলভিত্তিক বিভিন্ন পত্রিকায় আত্মপ্রকাশ ঘটে।
৯। বাংলাদেশ: ১৭ এপ্রিল বরিশাল থেকে বাংলাদেশ নামে একটি অনিয়মিত অর্ধ-সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এ পত্রিকাটি তার প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয়তে বিশ্বের মানবতাকামী সকল রাষ্ট্রের ও জনসাধারণের মানবতাবোধের কাছে বর্বর অত্যাচারের বিরুদ্ধে রক্ত শপথে রুখে দাঁড়াবার আবেদন জানায়।

১০। বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা: ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমগুলোও বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো। তার মধ্যে হলো কায়রোর আল-আহরাম পত্রিকা ইত্যাদি।
১১। কায়রোর আল-আহরাম পত্রিকা: মিশরের কায়রোর আল-আহরাম পত্রিকার সম্পাদক ড. মাকসুদ বলেছিলেন, বাংলাদেশে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার নজিরবিহীন নিষ্ঠুর কার্যক্রমে বিশ্ববিবেক স্তম্ভিত হয়ে পড়েছে। এতে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে অনেক দাবি উত্থাপন করেন। যুগান্তর, হিন্দুস্তান টাইমস, কালান্তর, কম্পাস, নিউএজ প্রভৃতি পত্রিকা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ও শরণার্থীদের নিয়ে বিভিন্ন প্রতিবেদন ছাপে। যার মাধ্যমে খুব সহজে বিশ্ব জনমত গঠিত হয়। এতে বিশ্বের অনেক দেশ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়।

১২। বিবিসি: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বিবিসির অবদান স্মরণীয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বিবিসিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন অনুষ্ঠান পরিচালনা করা হতো। এ সমস্ত অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি অনুষ্ঠান হলো সাপ্তাহিক সংবাদ পরিক্রমা। এ অনুষ্ঠানে যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী পত্রিকাগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের উপর যে সমস্ত সংবাদ এবং প্রতিবেদন ছাপা হতো তার উপর বিশ্লেষণধর্মী মন্তব্য প্রচার করা হতো। এছাড়াও বিবিসিতে ২৫ মার্চ গণহত্যা ও ২৬ মার্চের বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারের খবর সম্প্রচার করা হয়েছিলো। এছাড়াও বিদেশী গণমাধ্যমের মধ্যে ডেইলি টেলিগ্রাফ, গার্ডিয়ান, নিউ স্টেটম্যান, টাইমস, ইকোনমিস্ট, সানডে টেলিগ্রাফ, অবজারভার, ফাইনানসিয়াল টাইমস, ডেইলি মিরর ও ভারতের অমৃত বাজার, আনন্দবাজার ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস অনেক অবদান রাখে।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে দেশি ও বিদেশি গণমাধ্যম যে কত বড় ভূমিকা রেখেছিলো তার পরিমাপ করা প্রায় দুঃসাধ্য। তাদের প্রচারিত বিভিন্ন অনুষ্ঠান, সংবাদ, প্রতিবেদন একদিকে যেমন মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা দিয়েছিলো ও বিশ্ব জনমত গঠনে সাহায্য করেছিলো। অপরদিকে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে মানসিকভাবে পর্যুদস্ত করতে সহায়তা করেছিলো। যার ফলে উদিত হয়েছিলো বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url