মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা বিস্তারিত জেনে নিন

প্রিয় পাঠক, আজকে আমি আপনাদের সাথে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা এই টপিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো। আশা করি আপনি এই পোস্টটি পুরো মনোযোগ সহকারে পড়বেন। আপনি যদি এই পোস্টটি পুরো মনোযোগ সহকারে পড়েন তাহলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন। প্রিয় পাঠক, চলুন বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা বিস্তারিত জেনে নিন
ভূমিকা:মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবজ্জ্বল ও রক্তাক্ত অধ্যায়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলার মানুষ অর্জন করে স্বাধীন সার্বভৌম একটি দেশ। স্বাধীনতা হলো একটি জাতির আজন্ম লালিত স্বপ্ন। স্বাধীন দেশের নাগরিক হওয়ার মধ্যে যেমন গৌরব থাকে, তেমনি পরাধীনতায় থাকে গ্লানি। 

আর তাই পরাধীন হয়ে কেউ বাঁচতে চায় না। দাসত্বের শৃঙ্খলে কেউ বাধা পড়তে চায় না। বাঙালি জাতিও চাইনি বছরের পর বছর ধরে শাসনের শোষণে পাকিস্তানের দাস হয়ে থাকতে। তাই তারা শৃঙ্খল ভেঙ্গে বেরিয়ে পড়েছিল আন্দোলনে, সোচ্চার হয়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামে। অবশেষে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পেয়েছিল তাদের স্বপ্নের স্বাধীনতা।

পটভূমি: ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে জন্ম নেয় ভারত ও পাকিস্তান নামের দুইটি পৃথক রাষ্ট্র। পাকিস্তান রাষ্ট্রের ছিল দুটি অংশ পশ্চিম পাকিস্তান আর পূর্ব পাকিস্তান। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানিরা কখনোই পূর্ব পাকিস্তানকে সমান মর্যাদা দেয়নি। বরং সবসময় চেয়েছে পূর্ব পাকিস্তান দমিয়ে রাখতে। পশ্চিম পাকিস্তান সংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক ও রাজনৈতিক বৈষম্য জর্জরিত করতে থাকে পূর্ব পাকিস্তানকে। 
শিল্প কারখানার কাঁচামালের জন্য পশ্চিম পাকিস্তান নির্ভর করতে পূর্ব পাকিস্তানের ওপর। শ্রমিকদের অল্প বেতন দিয়ে উৎপাদনের কাজ করাত। রাজস্ব থেকে আয়, রপ্তানি আয় প্রভৃতির সিংহভাগ ব্যয় হতো পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নে। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিরক্ষায় যেখানে 95% ব্যয় হতো, সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষায় ব্যয় হতো মাত্র পাঁচ শতাংশ। 

আবার, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরপেক্ষভাবে জয়ী হলেও পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী কোনভাবেই বাঙ্গালীদের হাতে শাসনভার তুলে দিতে চাইনি। পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার অভাব, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক শোষণ, অবকাঠামগত উন্নয়নে অবহেলা, মৌলিক নাগরিক অধিকারের হস্তক্ষেপ সহ সকল বৈষম্য স্বাধীন জাতি রাষ্ট্র গঠনের দাবিকে জোড়ালো করে তোলে।

বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মোষ ও বিকাশ: বাঙালি জাতির রাজনৈতিক সচেতনতা ও জাতীয়তাবাদের উন্মোষ পূর্ব থেকে হলেও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে তার জোরালো হয়। পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহু উর্দুকে পাকিস্থানের রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে শুরু হয় ভাষা আন্দোলন। 

এই ভাষা আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নেয় ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি। ঐদিন ভাষার দাবিতে রাজপথে শহীদ হন রফিক, সালাম বরকত জব্বার সহ অনেকে। ভাষা ও সংস্কৃতির উপর শাসকগোষ্ঠীর আঘাত ছিল বাঙালির কাছে তাদের অস্তিত্বের মূলে আঘাত স্বরূপ। একদিকে বাঙালিরা যেমন সংকটের প্রকৃতি ও গভীরতা বুঝতে পারে, অন্যদিকে তা মোকাবেলা করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। 

১৯৫৪ এর নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের জয় লাভ ১৯৬২ এর গণবিরোধী শিক্ষা কমিশন, ১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয় এই প্রত্যেকটি ঘটনার মধ্য দিয়ে বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনার স্ফুরণ ঘটে এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সে বাঙালি জাতীয়তাবাদ চূড়ান্ত স্মৃতিতে লাভ করে।

অপারেশন সার্চলাইট: ইতিহাসের ঘৃণিত গণহত্যা ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চের অপারেশন সার্চলাইট। ঐদিন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, পিলখানা, রাজারবাগ পুলিশ লাইনসহ ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় এবং ঢাকার বাহিরে দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলা চালিয়ে হত্যা করে অসংখ্য নিরস্ত্র বাঙালিকে। পরদিন থেকেই শুরু হয় প্রতিরোধ সংগ্রাম।

মুজিবনগর সরকার গঠন: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠন করা হয়। এই দিন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রও গৃহীত হয়। বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী করে গঠিত হয় ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথ তলায় মুজিবনগর সরকার। 

তখন থেকে এই জায়গার নতুন নাম হয় মুজিবনগর। পরবর্তীকালে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অনুযায়ী দেশ চলে থাকে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সবচেয়ে বেশি কার্যকর ও সুদৃঢ়প্রসারী সাংবিধানিক পদক্ষেপ ছিল মুজিবনগর সরকার গঠন। এ সরকারের নেতৃত্বে নয় মাসের মহান মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। বিশ্বব্যাপী জনসমর্থন আদায়ে এ সরকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ ও জনজুদ্ধ: ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ নিরস্ত্র জনগণের উপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আক্রমণ চালালে বাঙালি ছাত্র-জনতা, পুলিশ, ইপিআর ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনা সদস্যরা সাহসিকতার সাথে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। বিনা প্রতিরোধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে বাঙালিরা ছাড় দেয়নি। দেশের জন্য যুদ্ধ করতে গিয়ে বহ মুক্তিযোদ্ধা বিভিন্ন রণাঙ্গনে শহীদ হন। 

মুক্তিযোদ্ধাদের এ ঋন কোনদিন শোধ হওয়ার নয়। জাতি চিরকাল মুক্তিযোদ্ধাদের শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে মনে রাখবে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সর্বস্তরে বাঙালি অংশগ্রহণ করে। বাংলাদেশের বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর মানুষও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। তাই এ যুদ্ধ কে বলা হয় গনযুদ্ধ বা জনযুদ্ধ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মূল নিয়ামক শক্তি ছিল জনগণ। 

তাই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মী, ছাত্র, পেশাজীবী, নারী সাংস্কৃতিক কর্মীসহ সর্বস্তরের জনগণ নিজ নিজ অবস্থান থেকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। জীবনের মায়া ত্যাগ করে দেশকে শত্রুমুক্ত করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে।কর্নেল আতাউল গনি উসমানী কে প্রধান সেনাপতি করে মুক্তিবাহিনী গঠন করা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য পুরো দেশকে ১১ টি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিল। 

তেসরা ডিসেম্বর থেকে মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় মিত্র বাহিনী যুক্ত হয়ে যৌথভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করে। যুদ্ধে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী পরাজিত হয়ে ১৬ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য নিয়ে জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পণ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় হয়।

মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। নারী সক্রিয় ছিল কখনোও সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে, কখনো বা যুদ্ধক্ষেত্রের আড়ালে। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস যুগিয়েছেন, প্রেরণা যুগিয়েছেন এমন নারীর সংখ্যা অসংখ্য। অজানা-অচেনা মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করেছেন বহু নারী। 

চরম দুঃসময়ে পাকিস্তানে হানাদের হাত থেকে রক্ষা করতে নিজেদের ঘরে আশ্রয় দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের। অনেক সময় পাক-হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের কাছে নারীর মান মর্যাদা হারাতে হয়েছে এবং প্রাণও দিতে হয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে নারীদের এই সাহসী ও অর্গানিকা ভূমিকা পালনের স্বীকৃতি স্বরূপ তারা অনেকে রাষ্ট্রীয় খেতাবপ্রাপ্ত হয়েছেন।

মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙ্গালীদের অবদান: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালিরা বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন। বিভিন্ন দেশে তারা মুক্তিযুদ্ধের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছেন। বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন আদায়ে বিভিন্ন দেশের নেতৃবৃন্দের কাছে ছুটে গিয়েছেন। তারা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় প্রতিনিধির দল প্রেরণ করেছেন। পাকিস্তানকে অস্ত্র, গোলাবারদ সরবরাহ না করতে বিশ্বের বিভিন্ন সরকারের নিকট আবেদন করেছেন। এক্ষেত্রে ব্রিটেনের প্রবাসী বাঙ্গালীদের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

মুক্তিযুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক বিশ্ব: ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের বর্বর রচিত হত্যাকাণ্ডের খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে বিশ্ব জনমত বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের পক্ষে দাঁড়ায়। ভারত সে সময়ে এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়নও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন দেয়।

মুক্তিযুদ্ধে শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা: যুদ্ধের সময় দেশপ্রেম জাগ্রতকরণ, মনোবল বৃদ্ধি সহ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ বা অংশগ্রহণ করতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা ও অবদান ছিল খুবই প্রশংসনীয়। পত্র-পত্রিকায় লেখা, নাটক, কথিকা, জনপ্রিয় অনুষ্ঠান চরমপত্র ইত্যাদি মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সহায়তা করেছে।

পরিশেষে বলা যায় যে, মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির অহংকার। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ জাতিকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র এনে দেয়। এ স্বাধীনতা শহীদদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত। তাই এই স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আমাদের নিবেদিত প্রাণ হওয়া উচিত। 

নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানানো যেমন জরুরী, তেমনি নাগরিকদের নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হওয়া উচিত। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযোদ্ধাদের চেতনায় উদ্ভূত হয়ে কর্তব্যবোধ,ন্যায়নিষ্ঠা ও দেশপ্রেমের মাধ্যমে বাংলাদেশের যথার্থ অগ্রগতি নিশ্চিত করা সম্ভব।

উপসংহার

প্রিয় পাঠক, আজকে আমি আপনাদের সাথে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা এই টপিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। আশা করি আপনি এই পোস্টটি পুরো মনোযোগ সহকারে পড়েছেন এবং উপকৃত হতে পেরেছেন। এ রকম আরো তথ্য মূলক পোস্ট পড়তে আমাদের সাথেই থাকুন। আমরা সবসময় পাঠকের চাহিদা অনুযায়ী পোস্ট পাবলিশ করে থাকি। এই পোস্টটি পুরো মনোযোগ সহকারে পড়ার জন্য ধন্যবাদ।


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url