ঐতিহাসিক স্থান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা জানিয়ে বন্ধুকে চিঠি
ঐতিহাসিক স্থান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা জানিয়ে বন্ধুকে চিঠি
প্রিয় বন্ধু তারেক,
আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা নিও। অনেকদিন তোমার কোনো চিঠিপত্র পাচ্ছি না। আমার কথা ভুলে গেছো? কোন অভিমানে তুমি চিঠি লেখা বন্ধ করেছো আমি জানি না। আশা করি, আমার এ চিঠি পাওয়ার পর তোমার অভিমানের বরফ গলবে।
আজ তোমাকে চিঠি লিখতে বসেছি স্বাধীন বাংলার কিছু ঐতিহাসিক স্থান পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা জানাতে। স্বাধীনতা দিবসের ছুটিতে আমি এবং আমার ছোট ভাই আরিফুল ইসলাম বেড়াতে গিয়েছিলাম স্বাধীন বাংলার কিছু ঐতিহাসিক স্থানে। এসব স্থানের ইতিহাস চিঠির মাধ্যমে লিখে তোমাকে বোঝাতে পারব না। তারপরেও কিছু ইতিহাস তোমাকে জানাতে চায় চিঠির মাধ্যেমে। আমরা যেসব স্থান গিয়েছিলাম সেগুলো হলো: জাতীয় স্মৃতিসৌধ, অপরাজেয় বাংলা, মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ, বুদ্ধিজীবি স্মৃতিসৌধ, শিখা চিরন্তন ও রায়বাজার বধ্যভূমি।
সকাল সাতটায় নাশতা সেরে আমরা দুই ভাই এসব স্থান পরিদর্শনের উদ্দেশ্য রওনা দিলাম। প্রথমেই গেলাম জাতীয় স্মৃতিসৌধে। মুক্তিযুদ্ধে লক্ষ লক্ষ নাম না-জানা শহিদের অমর স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত জাতীয় স্মৃতিশোধ। এটি ঢাকা শহর থেকে ৩৫ কি.মি উত্তর-পশ্চিমে সাভারে অবস্থিত। স্থপতি মঈনুল হোসেনের নকশা অনুযায়ী জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। সাতটি জোড়া ত্রিভুজাকার দেয়ালের মাধ্যমে ছোট থেকে বড় হয়ে ধাপে ধাপে স্মৃতিসৌধটি ১৫০ ফুট উচ্চতায় পৌঁছেছে।
সমগ্র স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণের সৌন্দর্য ও গাম্ভীর্য বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন উপাদন ব্যবহার করা হয়েছে। স্মৃতিস্তম্ভের মূল বেদিতে যেতে হলে বেশ দীর্ঘ উঁচু-নিচু পথ, পেভমেন্ট ও একটি কৃত্রিম লেকের উপর নির্মিত সেতু পার হতে হয়। এই সবকিছুই আসলে আমাদের দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের প্রতীক। পাশেই রয়েছে গণকবর, যাঁদের অমূল্য জীবনের বিনিময়ে এদেশ শত্রুমুক্ত হয়েছে। মূল স্মৃতিসৌধে সাত জোড়া দেয়াল, মূলত বাঙালির গৌরবময় সংগ্রামের প্রতীক। এই রাজনৈতিক ঘটনাগুলো হলো; ১৯৫২, ১৯৫৪, ১৯৫৬, ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৬৯ এবং ১৯৭১।
আরো পড়ুন: প্রতিবেদন লেখার নিয়ম
বলার অপেক্ষা রাখে না, এই সাতটি গুরুত্বপূর্ণ সালের মধ্যেই আমাদের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস নিহিত। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত ঘটনার ফলেই পরধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে বাঙালি স্বাধীনতা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। আর জাতীয় স্মৃতিসৌধ বারবার আমাদের সেই মহান শহিদদের কথাই মনে করিয়ে দেয়। ১৯৭২ সালে জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ১৯৮২ সালে তিনটি পর্যায়ে তা সম্পন্ন হয়। বাঙালির গৌরব আর মর্যাদার প্রতীক এই স্মৃতিসৌধ। বলে রাখি বন্ধু, আমরা স্মৃতিসৌধটি পরিদর্শন করে হাজারো বাঙালি শহিদদের স্মরণ করেছিলাম।
তারপর আমরা গিয়েছিলাম, অপরাজেয় বাংলা পরিদর্শন করতে। সেখানে গিয়ে আরো একটি অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম। অপরাজেয় বাংলা বাঙালির প্রতিবাদী মনোভাব ও মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াকু চেতনার মূর্ত প্রতীক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন চত্বরে ৬ ফুট উঁচু বেদির ওপর অপরাজেয় বাংলা নির্মিত। মূল ভাস্কর্যের উচ্চতা ১২ ফুট, প্রস্থ ৮ ফুট ও ব্যাস ৬ ফুট। বাংলাদেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে ছাত্রসমাজের গরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ প্রতিটি সংগ্রামে ছাত্রদের গৌরবময় ত্যাগকে স্মরণীয় করার জন্য অপরাজেয় বাংলা নির্মাণ করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা ভাস্কর সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ এটি নির্মাণ করেন। ১৯৭৩-১৯৭৯ সাল পর্যন্ত এই ভাস্কর্যের নির্মাণকাজ চলে। এই ভাস্কর্যে অসম সাহসী তিনজন তরুণ-তরুণী মুক্তিযোদ্ধার অবয়ব অপূর্ব দক্ষতায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। দুইজন তরুণ রাইফেল হাতে শত্রুর মোকাবেলায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, আর ঔষধের ব্যাগ কাঁধে তরুণী মুক্তিযোদ্ধাদের সেবায় নিবেদিতপ্রাণ। অপরাজেয় বাংলা বাংলাদেশের ছাত্রসমাজের প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে যুগের পর যুগ।
আরো পড়ুন: মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস
তারপর আমরা গেলাম, মুজিবনগর স্মৃতিসৌধে। মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বকারী মুজিবনগর সরকারের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরে এই স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। স্মৃতিসৌধে ২৪টি পৃথক ত্রিভুজাকৃতির দেয়াল বৃত্তাকারে ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে সর্বশেষ উচ্চতায় স্থির হয়েছে। ২৪টি ত্রিভুজাকৃতির দেয়াল হলো ২৪ বছরের পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শোষণের প্রতীক। ১৯৪৭ সাল থেকে এদেশের জনগণ তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে ক্রমে সংগঠিত হয়েছে। একপর্যায়ে দৃঢ় মনোবল আর সংকল্প নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশকে স্বাধীন করেছে। কারণ এখানেই শপথ নিয়েছিলো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার। এই স্মৃতিসৌধের স্থপতি ছিলেন তানভীর কবির। প্রিয় বন্ধু, বলা যায় আমরা দুই ভাই আরেকটি অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলাম।
পরবর্তীতে আমাদের বুদ্ধিজীবি স্মৃতিসৌধটি দেখার প্রবল আগ্রহ জাগলো। সেই আগ্রহ থেকে আমরা গেলাম বুদ্ধিজীবি স্মৃতিসৌধে। বাঙালি জাতিকে মেধা শূন্য করার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের সময় অগণিত বুদ্ধিজীবিকে হত্যা করা হয়। তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিকে মানবতাবিরোধী এই বর্বর কাজে সহায়তা করেছে রাজাকার ও আলবদর বাহিনী। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী চূড়ান্ত পরাজয়ের দুই দিন পূর্বে ১৪ই ডিসেম্বর অসংখ্য বুদ্ধিজীবিকে হত্যা করা হয়। তাঁদের স্মৃতি অমর করে রাখার জন্য ঢাকার মিরপুরে শহিদ বুদ্ধিজীবি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। এর স্থপতি ছিলেন মোস্তফা আলী কুদ্দুস। ১৯৭২ সালে এই স্মৃতিসৌধের নির্মাণকাজ শেষ হয়।
প্রিয় বন্ধু বলে রাখি, আমরা পরবর্তীতে আরও দুটি জায়গায় ভ্রমণ করেছি এবং সেখানকার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। সেই দুইটি জায়গা হলো শিখা চিরন্তন এবং সবার শেষে গেলাম রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে। শিখা চিরন্তন মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী বীর শহিদদের অমর স্মৃতি চির জাগরূক রাখার জন্য ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১৯৯৭ সালের ২৬শে মার্চ স্থাপিত হয়।
আরো পড়ুন: শিক্ষা সফরে যাওয়ার জন্য আবেদন পত্র
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে এই স্থান থেকেই মুক্তির সংগ্রাম ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৬ই ডিসেম্বর তৎকালীন পাকিস্তান দখলদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শিখা চিরন্তন স্থাপন করা হয়।
এবং পরিশেষে, আমরা রায়েরবাজার বধ্যভূমি ভ্রমণে যায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা করেছে। সারা দেশেই ছড়িয়ে আছে অগণিত বধ্যভূমি ও গণকবর। তখন রায়েবাজার এলাকাটি ছিল বেশ নিরিবিলি। জনবসতি খুব একটা চোখে পড়ত না। কালুশাহ পুকুরপাড় থেকে গোল মসজিদ পর্যন্ত দৈর্ঘ্য প্রায় তিন কিলোমিটার। মার্চ মাস থেকেই রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে পরিণত হয়। এখানে মানুষকে শুধু হত্যা করা হয়েছে তা নয়, অগণিত লাশ এনে ফেলা হয়েছে এই বধ্যভূমিতে। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস এখানকার ইটখোলোর রাস্তা দিয়ে লোকজন হাঁটাচলার সাহস করত না।
১৯৭১ সালের ১৮ই ডিসেম্বর রায়েরবাজার বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া যায়। সেদিন এই বধ্যভূমির বিভিন্ন শর্ত থেকে প্রচুর গলিত ও বিকৃত লাশ উদ্ধার করা হয়। এখানে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে অধ্যাপক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, চিকিৎসকের লাশই অধিক ছিল। বুদ্ধিজীবিদের হত্যাকাণ্ডে আলবদর ও রাজাকাররা প্রধান ভূমিকা পালন করে রায়েরবাজারে উদ্ধারকৃত লাশগুলো এতটাই বিকৃত হয়ে পড়ে যে, তাদের পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি। তবে যে কয়েকজনের পরিচয় জানা সম্ভব হয়েছে, তাঁরা হলেন; অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, সাংবাদিক সেলিনা পারভীন, ডা. ফজলে রাব্বী, চক্ষু চিকিৎসক ডা. আলীম চৌধুরী প্রমুখ।
প্রিয় বন্ধু, আমরা এসব দেখতে দেখতে যেন অতীতে হারিয়ে গেলাম। স্মরণ করলাম সেই ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধকে আর তার সাথে সাথে স্মরণ করলাম সেই মহান মুক্তিযুদ্ধে সকল বাঙালি ভাইদের যারা দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে। সময় পেলে তুমিও একবার দেখে আসিও বন্ধু সেই ঐতিহাসিক স্থানগুলো আশা করি, তুমিও জানতে পারবে দেশের জন্য সেকল বাঙালি ভাইয়েরা জীবন দিয়েছে তাদের ইতিহাস।
ইতি
তোমার প্রিয় বন্ধু,
সুজন মাহমুদ।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url