খাদ্য ভেজাল অনুচ্ছেদ রচনা বিস্তারিত জেনে নিন
ভূমিকা
খাদ্য ভেজাল বলতে মূলত বুঝায় বেশি দামের পণ্যের সাথে কম দামের পণ্য কিংবা খাদ্যপণ্যের সাথে অখাদ্য-কুখাদ্য মিশিয়ে বিক্রি করা। চালের সাথে পাথরকুচি, ঘিয়ের সাথে পশুচর্বি, লবণের সাথে বালু ইত্যাদি ভেজাল সম্পর্কে কমবেশি সবারই জানা। আধুনিককালে খাদ্যপণ্য যান্ত্রিক প্রক্রিয়াকরণের সময় ভেজাল ও অখাদ্য এমনভাবে মেশানা হয় যে, আসল-নকলের পার্থক্য নিরূপণ করা সাধারণভাবে সম্ভব হয়ে উঠে না।
খাদ্য ভেজালের কারণ
খাদ্য ভেজাল দেওয়ার মূল কারণ ব্যবসায়ীদের অতিমাত্রায় অর্থলালসা ও নৈতিকতার অভাব। তারা সামান্য বাড়তি লাভের আশায় মানুষকে প্রতারিত করে এবং ক্ষেত্রবিশেষে মানুষের মুখে বিষ উঠিয়ে দেয়। কিন্তু ব্যবসায়ীদের এই অপচেষ্টা সফল হতো না যদি সরকারের যথাযথ তদারকি থাকতো এবং আইনের কড়াকড়ি প্রয়োগ হতো। বাংলাদেশে অধিকাংশ খাদ্য উপকরণ, পণ্য ও তৈরিখাদ্য প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন নেই, নেই বিএসটিআই কর্তৃক প্রদত্ত ছাড়পত্র।
ভুয়া লাইসেন্স কিংবা ছাড়পত্র দেখিয়ে অবলীলায় ভেজাল খাদ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করা হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থাকে নির্বিকার। ব্রিটিশ আমলের কমমূল্যের ভেজালবিরোধী আইন আজও সংস্কার করা হয়নি। ভেজালের জন্য ভোক্তাদের অসচেতনতাও কম দায়ী নয়। অনেকেই সামান্য কমমূল্যের কারণে জেনে বুঝেই খাবার অযোগ্য পণ্য সামগ্রী ক্রয় করে থাকে। সর্বোপরি জাতি হিসেবে আমাদের হীন মানসিকতা ও সততার ক্ষেত্রে দৈন্যই খাদ্যে ভেজালের প্রধান কারণ।
খাদ্য ভেজালের নানারূপ
ভেজালবিহীন খাদ্য দেশে পাওয়া এক কথায় দুরূহ। সুদৃশ্য মোড়কবন্দি কিংবা খোলা কোনো পণ্যই ভেজাল ছাড়া নেই। খাদ্যে ভেজালের কতিপয় দিক নিম্নে তুলে ধরা হলোঃ
শাকসবজি ও ফলমূল: আমরা প্রতিদিন যেসব শাকসবজি ও ফলমূল খাচ্ছি সেগুলো সতেজ রাখতে ও পাকাতে বিক্রেতারা ক্যালসিয়াম কার্বাইডসহ বিভিন্ন বিষাক্ত কেমিক্যাল ব্যবহার করছে। এসব কেমিক্যাল মিশ্রিত শাকসবজি ও ফলমূল খেলে কিডনি ও লিভার নষ্ট হতে পারে, চোখের দৃষ্টিশক্তি হ্রাস ছাড়াও ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ রচনা
ঘি ও ভোজ্যতেল: মহাখালিস্থ বাংলাদেশ জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের খাদ্য পরীক্ষাগার ও সিটি কর্পোরেশনের পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করে দেখা গেছে বাজারজাতকারী গাওয়া ঘি ৯৩ ভাগ ভেজাল ও খাবারের অনুপযোগী; বাটার অয়েল ৯২ ভাগ ভেজাল, ডালডা ১০০ ভাগ ভেজাল, সয়াবিন ও সরিষার তেল ৯২ ভাগ ভেজাল এবং খাবারের অনুপযোগী। এসব ভোজ্যতেল খেলে কিডনি, লিভারের ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা খুব বেশি। ভোজ্যতেল ও ঘি-এ সাধারণত ক্ষতিকর রং, পশুচর্বি ও ঝাঁঝ বৃদ্ধির কেমিক্যাল মেশানো হয়।
মাছ, মাংস ও শুঁটকি: ছোট-বড় বিভিন্ন মাছকে সতেজ রাখতে ও সেগুলো সতেজ দেখানোর জন্য বিক্রেতারা ফরমালিন নামক রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে, যা মানবদেহের জন্য মারত্মক ক্ষতিকর। এছাড়া শুঁটকি মাছের সাথে অসাধু ব্যবসায়ীরা বিষাক্ত কীটনাশক ও ডিডিটি ব্যবহার করে, যা মানবদেহে ক্যান্সার, হৃদরোগসহ বিভিন্ন জটিল রোগ সৃষ্টি করে। বিশেষ করে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত মাছে ফরমালিনের ব্যবহার মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ। খাসির মাংসের নামে ভেড়ার মাংস ও গরুর মাংস হিসেবে দেখিয়ে বিক্রি হয় মহিষের মাংস।
চাল-ডাল ও আটা-ময়দা: চালে পাথর-বালি মেশানো সাধারণ ঘটনা বাজারে বেশিরভাগ ডালই ভেজাল ও খাওয়ার অযোগ্য। ডালে থাকে ক্ষতিকারক রং ও ছত্রাক। তাছাড়া ডালে মাইকোটক্সিন নামক বিষাক্ত কেমিক্যাল ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। পাউরুটি, বিস্কুট, নুডলসের আটা-ময়দা ৯৬ ভাগ ভেজাল, নিম্নমানের ও খাবার অনুপযোগী। মুড়ি ভাজতে ব্যবহৃত হয় ইউরিয়া সার। এসব বিষাক্ত রং মিশ্রিত খাদ্যের জন্য দেশে ডায়াবেটিস ছাড়াও কিডনি ও লিভারসহ অন্যান্য অঙ্গে ক্যান্সার ও মারাত্মক সব রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আরো পড়ুন: স্বদেশপ্রেম রচনা
মিনারেল ওয়াটার, জুস, জ্যাম ও জেলি: পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে, বাজারের মিনারেল ওয়াটার নামে বিক্রি হওয়া পানির ৯৬ ভাগই পানের অযোগ্য। এছাড়া বাজারজাতকৃত ৯৭ ভাগ জুসের মধ্যে ফলের রস বলতে কিছু নেই। বাজারের বেশিরভাগ জুস, জ্যাম, টমেটো সস ও জেলিতে যে বিষাক্ত রং মেশানো হয় তা কিডনি, লিভার ও পেটের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এছাড়া বাজারের ৯৬ ভাগ আইসক্রিম খাওয়ার অযোগ্য। এসব খাবারে ফলের যে স্বাদ পাওয়া যায় তা কৃত্রিম স্বাদগন্ধ ও মিষ্টতার জন্য চিনি-স্যাকারিন ছাড়া কিছুই নয়।
শিশুখাদ্য ও মুখরোচক খাদ্য: বাজারে শিশুখাদ্য নামে যা চলে তার অধিকাংশই ভেজাল। বিশ্বখাত ব্যান্ডের শিশুখাদ্যের প্যাকেটে যেসব উপাদান-উপকরণের নাম লেখা থাকে সেগুলো আনুপাতিক হারে পাওয়া যায় না। সাধারণ গুঁড়ো দুধ শিশুদের উপযোগী বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। গরুর দুধে নদীর পানি পর্যন্ত মেশানো হয়। লজেন্স, চকোলেটসহ অন্যান্য মুখরোচক খাদ্যে ক্ষতিকারক গন্ধ ও রং মেশানো হয়।
তৈরি খাবার ও হোটেল-রেস্তোরাঁর চিত্র: তৈরি খাবারে কাপড়ের রং মেশানো এবং মবিল দিয়ে চানাচুর ভাজার কথা আজকাল অনেকেই জানে। রাস্তার পাশে জিলাপীর দোকানের জিলাপীতে মবিল ও এক ধরনের রং মেশানো হয় এবং মিষ্টির দোকানগুলোতে মিষ্টি তৈরিতে মেয়াদোত্তীর্ণ বিষাক্ত গুঁড়ো দুধ, রং ও টিস্যু পেপার মেশানো হয়। এছাড়া রাস্তার পাশে ছোট ছোট দোকানগুলোর প্রায় সবগুলোতেই পিঁয়াজু, সিঙ্গারা, পরোটা, পুরিসহ তেলে ভাজা খাদ্যগুলো বহুবার ব্যবহৃত তেলে ভাজা হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, ৯৬ ভাগ রেস্তোরার খাবারের মান খুব খারাপ। এসব রেস্টেুরেন্টে পচা মাংস, বিষাক্ত রং ও কেমিক্যাল ব্যবহৃত হয়।
খাদ্য ভেজালের প্রভাব
খাদ্য ভেজাল ও অপদ্রব্য মেশানোর ফলে মানুষ প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছে। চাল-ডাল থেকে ভেজাল ও অপদ্রব্য বাদ দিলে মানুষ আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ভেজাল খাবার খেয়ে মানুষ ক্যান্সার, শ্বাসকষ্ট, কিডনি রোগ, জন্ডিস, পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হয়। ভেজাল খাদ্যের সবচেয়ে মারাত্মক শিকার হয় শিশুরা। রং ও কেমিক্যালযুক্ত খাবার খেয়ে শিশুরা প্রায়শ দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। ভেজাল খাদ্য আমাদের দেশের জনস্বাস্থ্যকে মারাত্মক ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছে।
ভেজাল প্রতিরোধে করণীয়
খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে সবার আগে মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে। জনসচেতনাতাই ব্যবসায়ীদের অপতৎপরতা রোধ করার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে। আমাদের ভেজালবিরোধী আইনকে আরও যুগোপযোগী করতে হবে। ভেজালকারীদের কঠোর শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে। বি এসটিআইকে দুর্নীতিমুক্ত ও আরও সক্রিয় করতে হবে। ভেজালবিরোধী অভিযানকে আরও জোরদার করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। ভেজাল বিরোধী সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার পাশাপাশি ভোক্তা অধিকার আন্দোলন জোরদার করতে হবে। ব্যবসায়ীদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের জন্য মোটিভেশন কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।
উপসংহার
খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল আমাদের দেশের সর্বগ্রাসী দুর্নীতিরই একটি সূচক। এটি আমাদের নৈতিকতার দৈন্যকেই প্রকটতর করে তোলে। ভেজাল খাদ্য আমাদের কেবল আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে না, আমাদের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির মুখেও ঠেলে দেয়। খাদ্যে ভেজালের এ অবস্থা অব্যাহতভাবে চলুক এটি কেউই কামনা করতে পারে না। ভেজাল খাদ্যের অভিশাপ থেকে আমাদের অবশ্যই মুক্তি পেতে হবে। সচেতন ব্যক্তি মাত্রই আশা করে সরকার খাদ্যভেজাল প্রতিরোধে আরও কার্যকর ব্যবস্থা নেবে।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url