বিদায় হজের ভাষণ সম্পূর্ণ জেনে নিন

মক্কা বিজয়ের পর দলে দলে লোক ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে। আরবের সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ইসলাম পৌঁছে যায়। হজরত মুহাম্মাদ (সা.) বুঝলেন আর বেশিদিন তাঁর পৃথিবীতে থাকা হবে না। তাই ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে (দশম হিজরিতে) হজ করার ইচ্ছা করলেন। এ উদ্দেশ্যে উক্ত সালের যিলকদ মাসে লক্ষাধিক সাহাবি নিয়ে হজরত মুহাম্মাদ (সা.) হজ করার উদ্দেশ্যে রওনা হন যা ইসলামের ইতিহাসে বিদায় হজ নামে পরিচিত। এ হজে রাসুল (সা.)-এর সহধর্মিণীগণও তাঁর সঙ্গে ছিলেন।
বিদায় হজের ভাষণ সম্পূর্ণ জেনে নিন
যুল হুলাইফা নামক স্থানে এসে সকলে ইহরাম ( হজের পোশাক) বেঁধে বাইতুল্লার উদ্দেশ্য রওনা হন। জিলহজ মাসের নবম তারিখে আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত জনসমুদ্রের উদ্দেশ্য মহানবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) ইতিহাসের এক যুগান্তকারী ভাষণ দেন। এ ভাষণে বিশ্ব মানবতার সকল কিছুর দিকনির্দেশনা ছিল। আরাফাতের ময়দানের পার্শ্বে ‘জাবালে রহমত’ নামক পাহাড়ে উঠে মহানবি হজরত মুহাম্মাদ (সা.) প্রথমে আল্লাহর প্রশংসা করলেন। অতঃপর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন যা বিদায় হজের ভাষণ নামে পরিচিত

বিদায় হজের ভাষণ

১। হে মানব সকল! আমার কথা মনোযোগ সহকারে শোনবে। কারণ আগামী বছর আমি তোমাদের সাথে এখানে সমবেত হতে পারব কিনা জানি না।

২। আজকের এই দিন, এ স্থান, এ মাস যেমন পবিত্র, তেমনই তোমাদের জীবন ও সম্পদ পরস্পরের নিকট পবিত্র।

৩। মনে রাখবে অবশ্যই একদিন সকলকে আল্লাহর সামনে উপস্থিত হতে হবে। সেদিন সকলকে নিজ নিজ কাজের হিসাব দিতে হবে।

৪। হে বিশ্ববাসীগণ! স্ত্রীদের সাথে সদয় ব্যবহার করবে। তাদের উপর তোমাদের যেমন অধিকার আছে তেমনই তোমাদের উপরও তাদের অধিকার আছে।

৫। সর্বদা অন্যের আমানত রক্ষা করবে এবং পাপ কাজ থেকে রিত থাকবে ও সুদ থেকে দূরে থাকবে।

৬। আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করবে না। আর অন্যায়ভাবে একে অন্যকে হত্যা করবে না।

৭। মনে রেখ! দেশ, বর্ণ-গোত্র, সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল মুসলমান সমান। আজ থেকে বংশগত শ্রেষ্ঠত্ব বিলুপ্ত হলো। শ্রেষ্ঠত্বের একমাত্র মাপকাঠি হলো আল্লাহভীতি ও সৎকর্ম। সে ব্যক্তিই সবচাইতে সেরা, যে নিজের সৎকর্ম দ্বারা শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে।

৮। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করবে না, পূর্বের অনেক জাতি এ কারণেই ধ্বংস হয়েছে। নিজ যোগ্যতা বলে ক্রীতদাস যদি নেতা হয় তার অবাধ্য হবে না। বরং তার আনুগত্য করবে।

৯। দাস-দাসীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করবে। তোমরা যা আহার করবে ও পরিধান করবে তাদেরকেও তা আহার করাবে ও পরিধান করাবে। তারা যদি কোনো অমার্জনীয় অপরাধ করে ফেলে, তবে তাদের মুক্ত করে দেবে, তবুও তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করবে না। কেননা তারও তোমাদের মতোই মানুষ, আল্লাহর সৃষ্টি। সকল মুসলিম একে অন্যের ভাই এবং তোমরা একই ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ।

১০। জাহেলি যুগের সকল কুসংস্কার ও হত্যার প্রতিশোধ বাতিল করা হলো। তোমাদের পদ প্রদর্শনের জন্য আল্লাহর বাণী এবং তাঁর রাসুলের আদর্শ রেখে যাচ্ছি। এগুলো যতদিন তোমরা আঁকড়ে থাকবে ততদিন তোমরা বিপথগামী হবে না।

১১। আমিই শেষ নবি। আমার পর কোনো নবী আসবে না এই পৃথিবীতে।

১২। তোমরা যারা উপস্থিত আছো তারা অনুপস্থিতদের কাছে আমার বাণী পৌঁছে দেবে।

তারপর হজরত মুহাম্মাদ (সা.) আকাশের দিকে তাকিয়ে আওয়াজ করে বলতে লাগলেন, হে আল্লাহ! আমি কি তোমার বাণী সঠিকভাবে তোমার বান্দাদের নিকট পৌঁছাতে পেরেছি? সাথে সাথে উপস্থিত জনসমুদ্র থেকে আওয়াজ এলো হ্যাঁ। নিশ্চয়ই পেরেছেন। অতঃপর হজরত মুহাম্মাদ (সা.) বললেন, হে আল্লাহ তুমি সাক্ষী থাক। এরপরই আল্লাহ তায়ালা কোরআনের আয়াত নাজিল করলেন এবং বললেন, আজ আমি তোমাদের ধর্মকে পূণাঙ্গ করে দিলাম এবং আমার নিয়ামত তোমাদের জন্য পরিপূর্ণ করে দিলাম। ইসলামকে তোমাদের পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা হিসেবে মনোনীত করলাম। (সূরা আলা-মায়িদা, আয়াত ৩)।
মহানবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) কিছুক্ষণ নীরব থাকলেন। জনতাও নীরব থাকল। অতঃপর সকলের দিকে করুণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ‘আল বিদা’ (বিদায়)। একটা অজানা বিয়োগ-ব্যাথা উপস্থিত সকলের অন্তরকে ভারাক্রান্ত করে তুলল।

মহানবি হজরত মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর ভাষণের মাধ্যমে যে দিকনির্দেশনা তুলে ধরেছিলেন বাস্তব জীবনে তিনি তা অনুশীলন করেছেন। আমরাও আমাদের ভাষণে বা বক্তব্য যা বলব জীবনে তা অনুশীলন করব। তাহলে আমাদের দেশ ও জাতি আরও সুন্দর, সমৃদ্ধ ও উন্নত হবে।

বিদায় হজের তাৎপর্য

হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর বিদায় হজের অভিভাষণ মুসলিম উম্মাহর জন্য সর্বকালের পথ প্রদর্শক। এই অমূল্য ভাষণে তিনি একটি আদর্শ মুসলিম সমাজ-ব্যবস্থার চিত্র জনগণের নিকট তুলে ধরেন। তাদেরকে তিনি তমসাযুগের অসামন্য, প্রতিহিংসা, নিষ্ঠুরতা, শ্রেণি বৈষম্য, সুদ প্রথার মাধ্যমে শোষণ নির্যাতন, নারী ও দাসদাসীর প্রতি অন্যায়-অবিচার, কুসংস্কারাচ্ছন্ন প্রাচীন রীতিনীতি প্রভৃতি অসামাজিক কার্যকলাপ অবসানের জন্য আহ্বান জানান। 

মহানবি হজরত মুহাম্মাদ (সা.) এর বিদায় হজের ভাষণ ইসলামি রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি ও মানবিক অধিকারের মূলনীতি বিষয়ক একটি দলিল। এই ভাষণে মানবজীবনের আধ্যাত্মিক ও বাস্তব উভয় শিক্ষার সুস্পষ্ট প্রতিফলন রয়েছে। বস্তুত এই শিক্ষাতেই মানবজাতির মুক্তি ও শক্তি নিহিত। হজরত মুহাম্মাদ (সা.) এর এই বক্তব্যের আদর্শ বাস্তবায়িত হলে মানবজীবন নিঃসন্দেহে শান্তিময় হয়ে উঠবে।

হজরত মুহাম্মাদ (সা.) এর কৃতিত্ব ও সংস্কারসমূহ

ইসলামি জীবন বিধান কোনো মানুষের চিন্তার ফল নয় তা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত ব্যবস্থা। এ জীবন ব্যবস্থার বিধি-বিধান মহানবি হজরত মুহাম্মাদ (সা.) ওহির মারফত প্রাপ্ত হয়েছিলেন। যে সকল কার্যকারী সংস্কার ও ব্যবস্থার মাধ্যমে মহানবি হজরত মুহাম্মাদ (সা.) পতনোমুখ আরব জাতির মধ্যে জাগরণ আনয়ন করেন, একটি ঘৃণিত ও অজ্ঞাত আরব জাতিকে সম্মানের উচ্চাসনে সমাসীন করেন, লুন্ঠনকারী আরব জাতিকে অপরের সম্পদ হিফাজত ও রক্ষণাবেক্ষণে দায়িত্বশীল করে গড়ে তোলেন, 

মদ্যপানে আসক্ত আরব জাতিকে মদ্যপানে নিরাসক্ত করে তোলেন, জ্ঞানাদ্ধ ও মূর্খ আরব জনতাকে জ্ঞান-পিসাসু করে গড়ে তোলেন, আরবের মুশরিকদের তৌহিদবাদীতে রূপান্তরিত করেন, দাস প্রথার বিলোপ সাধনে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করেন এবং সভ্যতা বিবর্জিত আরব জাতিকে একটি উন্নয়শীল সুসভ্য জাতিরূপে গড়ে তোলেন-সে সম্বন্ধে নিম্নে আলোচনা করা হলো। 

রাজনৈতিক সংস্কারঃ প্রাক-ইসলামি আরবে কোনো সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ ছিল না। এজন্য বিচ্ছিন্ন গোত্র সম্প্রদায় বিভক্ত আরববাসীদের মধ্যে কোন রাজনৈতিক বন্ধন গড়ে ওঠেনি। দেশে কোনো বিধিবদ্ধ নিয়ম-কানুন ও শৃঙ্খলা না থাকায় অসংখ্য গোত্র ও সম্প্রদায় বিভক্ত আরবদের মধ্যে কলহ-বিবাদ ছিল চিরাচরিত ঘটনা। তাদের দস্যুবৃত্তি রাজনৈতিক অঙ্গনে অশান্তি ও অনর্থের সৃষ্টি করে। মহানবি (সা.) শতধা-বিভক্ত ও বিবদমান আরব জাতির গোত্র ভিত্তিক রাজনীতির অবসান ঘটান। তার প্রদত্ত মদিনা সনদ গোত্র প্রথার বিলোপ সাধন করে ইসলামি ভ্রাতৃত্ববোধের ভিত্তিতে একটি নতুন জাতি (উম্মাহ) প্রতিষ্ঠা করে। গোত্রগুলিকেও একই রাজনৈতিক গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ করেছিলেন।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাঁর এ প্রচেষ্টা পরবর্তীকালের বৃহত্তর ইসলামি সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেছিল। একমাত্র ধর্ম ও ইমানের দ্বারাই তিনি মদিনার রাজনৈতিক অঙ্গনে শৃঙ্খলার পরিবেশ সৃষ্টি করেন। ফলে নব প্রতিষ্ঠিত ইসলামি রাষ্ট্রে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব পৌত্তলিকতার স্থান দখল করে করে নেয়। মদিনায় ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার পর হজরত মুহাম্মাদ (সা.) এই রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামো তৈরিতে মনোনিবেশ করেন। শাসন ব্যবস্থায় তিনি ঐশীতন্ত্র ও গণতন্ত্রের সমন্বয় সাধন করার ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় কার্যাদি সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত হতে থাকে।

বসওয়ার্থ যথার্থই বলেছেন, যদি কেহ ঐশ্বরিক বিধান সম্মত শাসনবিধি প্রতিষ্ঠার গৌরব দাবি করতে পারেন, তবে তিনি মুহাম্মাদ (সা.) ছাড়া আর কেউ নন। মদিনায় হিজরতের পর মহানবি (সা.) সেখানে সর্বপ্রথম একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। ক্রমে এই মসজিদই ইসলামের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। বস্তুত এই মসজিদ ছিল মহানবি হজরত মুহাম্মাদ (সা.) এর প্রার্থনাগার, শিক্ষায়তন, সভাগৃহ, সরকারি কার্যালয় এবং গোত্রীয় প্রতিনিধি ও বৈদেশিক দূতদের সাথে মিলনের কেন্দ্র। এখানেই বসে তিনি পবিত্র কুরআনের নির্দেশ, সাহবীদের পরামর্শ ও স্বীয় বিচারবুদ্ধি অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। রাষ্ট্রাধিনায়ক হিসাবে মুহাম্মাদ (সা.) এর কার্যকলাপ আগামী দিনের অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে কাজ করে।

শাসনকার্যের সুবিধার্থে হজরত মুহাম্মাদ (সা.) সমগ্র আরব উপদ্বীপকে কয়েকটি প্রদেশে ভাগ করেন। যেমন: মদিনা, খাইবার, মক্কা, তায়িফ, ইয়ামেন, সানা, ওমান ও বাহরাইন। প্রদেশের শাসনকর্তার উপাধি ছিল ওয়ালী। তিনি শুধু রাষ্ট্রনায়কই ছিলেন না, একাধারে তিনি ছিলেন ইমাম, প্রধান সেনাপতি ও বিচারক। শাসন পদ্ধতির কেন্দ্রীয়করণের ফলে দেশে শান্তি ও সমৃদ্ধির শুভ সূচনা হয়।

সামাজিক সংস্কারঃ হজরত মুহাম্মাদ (সা.) ছিলেন একজন যুগান্তকারী সমাজ সংস্কারক। তাঁর প্রবর্তিত সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব আরব সমাজে যুগ যুগ ধরে গড়ে ওঠা বৈষম্যর প্রাচীর ভেঙ্গে ধুলিস্যাৎ করে দেয় তিনি একটি আধুনিক ও উন্নত সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে এক অভূতপূর্ব বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেন। আভিজাত্যের অহংকার ও বংশমর্যাদার দম্ভ বিলোপ করে তিনি মানুষে মানুষে সকল অসান্য ও ভেদাভেদের মুলোচ্ছেদ করেন। তিনি মানবতার ভিত্তিতে সমাজ এবং ইসলামি বুনিয়াদের উপর একটি জাতি গঠন করতে সচেষ্ট হন। তিনি ঘোষণা করেন, সকল মানুষ সমান। মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং উত্তম সেই ব্যক্তি যিনি আল্লাহর প্রতি সর্বাধিক অনুগত এবং মানুষের সর্বাধিক কল্যাণকামী। এরূপ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই তিনি আরব সমাজ থেকে উচ্চ-নীচ, ধনী-দরিদ্র ও সাদা-কালো পার্থক্য দূরীভূত করেন।

নারীজাতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও সমাজ জীবনে নারীর মর্যাদা বৃদ্ধি হজরত মুহাম্মাদ (সা.) এর সমাজ সংস্কারের একটি উল্লেখযোগ্য দিক। ইসলামের আবির্ভাবের পূর্ব পর্যন্ত কোন ধর্মই নারীকে সমাজে তার প্রাপ্য মর্যাদা দান করেনি। এতকাল তারা ভোগের সামগ্রীরূপে গণ্য হত। মহানবি হজরত মুহাম্মাদ (সা.) সমাজে নারী জাতির মর্যাদা প্রতিষ্ঠাকালে নিরলস ভাবে কাজ করে যান। তিনি বলেন, তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি সর্বোত্তম, যে তার স্ত্রীর প্রতি সর্বোত্তম ব্যবহার করে। মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত এ বাণীর মাধ্যমে নারী জাতির প্রতি তার শ্রদ্ধাবোধের গভীরতা প্রকাশ পায়। 

তাঁরই প্রচেষ্টায় পুরুষের পবিত্র আমানত ও কল্যাণময়ী রূপে নারী সমাজে স্থান করেছে। হজরত মুহাম্মাদ (সা.) পারিবারিক ও বৈবাহিক আইন সংশোধন করে নারী জাতিকে ভোগের সামগ্রীর পরিবর্তে অর্ধাঙ্গিনী ও জীবনসঙ্গিনীরূপে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি তাদেরকে পিতা ও মৃত স্বামীর সম্পদে অধিকার এবং বিয়েতে সম্মতি প্রকাশের স্বাধীনতা প্রদান করেন। আরব সমাজে কন্যা সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর জীবন্ত প্রোথিত করার যে বর্বের রীতি প্রচলিত ছিল, তিনি তা চিরতরে রহিত করেন। মোট কথা, নারীর প্রতি শ্রদ্ধাপদর্শন ও তার মর্যাদা বৃদ্ধি মহানবি হজরত মুহাম্মাদ (সা.) এর প্রচারিত জীবন দর্শনের এক অপরিহার্য অংশ ছিল।

হজরত মুহাম্মাদ (সা.) আরবে তথা প্রায় সমগ্র বিশ্বে যুগ যুগ ধরে প্রচলিত ক্রীতদাস প্রথার মূলে কুঠারাঘাত করেন। সত্য যে, সে সময়ের বিরাজমান পরিস্থিতির জন্য তিনি অবশ্য দাস প্রথার মূলোচ্ছেদ করেতে পারেননি, তবে তিনিই তাদেরকে সর্বপ্রথম মানুষের মর্যাদায় উন্নীত করেন। দাসদাসীর জীবন মরণ নির্ভর করতো প্রভুদের মর্জি ও খেয়াল-খুশির উপর। ফলে মনিবগণ ক্রীত দাসদাসীদের প্রতি অমানুষিক অত্যাচার করতো। তারা হাটে-বাজারে এবং যত্রতন্ত্র পণ্য দ্রব্যের ন্যায় ক্রয়-বিক্রয় হতো। 

মানুষ হিসেবে সমাজে তাদের কোনো অধিকার ছিল না। মনীবের অনুমতি ব্যতীত তাদের বিয়ে করা পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল। মানুষের প্রতি মানুষের এরূপ নির্দয় আচরণে মহানবি (সা.) অত্যন্ত মর্মাহত হন। তাই তাদের মুক্তির পথ নির্দেশ করে তিনি ঘোষণা করেন, দাসদাসীদের প্রতি সদাচারণ ও উদার ব্যবহারের উপদেশ দেন। ব্যক্তি জীবনে তিনি অনেক দাসদাসী ক্রয় করে মুক্ত করেন এবং অনেকে এই কাজে তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। বহু দাসকে উচ্চ পদমর্যাদা দান করে তিনি আদর্শ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তাদের প্রতি তাঁর তদাচারণ এবং তাদেরকে উচ্চ পদে নিয়োগ ও সামাজিক মর্যাদা দানের ফলে ক্রমান্বয়ে দাস প্রথার বিলুপ্তির পথ সুগম হয়।

ইসলাম-পূর্ব যুগে আরবদের নৈতিক জীবন বলতে কিছুই ছিল না। মহানবি (সা.) তাদের নৈতিক অবস্থার উন্নয়নের উদ্দেশ্য হত্যা, মদ্যপান, জুয়াখেলা, সুদ খাওয়া, পর ধন হরণ, রাহাজানি, ব্যভিচার, পুরুষের সংখ্যাতীত স্ত্রী গ্রহণ এবং স্ত্রীলোকের বহুবিবাহ প্রথা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এরূপ তিনি আরব সমাজ থেকে সর্বাধিক পাপাচার, অনাচার কুসংস্কার দূরীভূত করে এক যুগান্তকারী ও সুদূরপ্রসারী বিপ্লব সাধন করেন।

অর্থনৈতিক সংস্কারঃ হজরত মুহাম্মাদ (সা.) এর আবির্ভাবের পূর্বে আরবে কোন সুষ্ঠু অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ছিল না। নগরবাসী ও স্থায়ীভাবে বসবাসকারী আরবগণ ব্যবসায়-বাণিজ্য ও কৃষিকার্য দ্বারা জীবন নির্বাহ করতো। তাদের আর্থিক অবস্থা মোটামুটি স্বচ্ছল ছিল। কিন্তু মরুচারী বেদুইনগণ যাযাবর বৃত্তি ও লুণ্ঠন দ্বারা জীবিকার সংস্থান করত। তারা দরিদ্র ও অভাবগ্রস্ত ছিল। ঘৃণা কুসীদ প্রথা ও অন্যান্য শোষণমূলক ব্যবস্থা চালু থাকায় দেশের সম্পদ মুষ্টিমেয় কতিপয় পুঁজিপতিদের হাতে কুক্ষিগত হয়েছিলো। হজরত মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর অন্যান্য সংস্কারের ন্যায় সমতার ভিত্তিতে অর্থনৈতিক সংস্কার চালু করেন। তিনি কুসীদ প্রথা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। 

দরিদ্র অভাবগ্রস্ত মানুষকে সাহায্য করার ও ধন সম্পদের সমবণ্টনের জন্য তিনি মুসলিম সমাজে যাকাত, সাদকাহ ও ফিতরা প্রবর্তন করে পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার মূলে আঘাত হানেন। রাষ্ট্রীয় আয়ের উৎস হিসেবে তিনি আল গাণিমাহ, যাকাত, জিজিয়া, খারাজ ও আল-ফাই-এর পরিমাণ নির্ধারণ করে দেন। বায়তুলমাল স্থাপন করে তিনি রাষ্ট্রের অর্থসম্পদ জনসাধারণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত এবং দীন-দুঃখীদের সাহায্যের ব্যবস্থা করেন। হজরত মুহাম্মাদ (সা.) কায়িক পরিশ্রম, কৃষি ও বাণিজ্যের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে সদুপায়ে অর্থোপার্জনে উৎসাহ দিতেন। জুয়া খেলার মাধ্যমে অর্থ রোজগারকে তিনি নিষিদ্ধ করেন। 

এককথায়, তিনি আরবের সমগ্র অর্থনৈতিক জীবনকে নৈতিকতার গণ্ডিতে আবদ্ধ করেন। তিনি বলেছেন, সমাজে কারও স্থান অর্থসম্পদের মাপকাঠিতে নির্ধারিত হবে না, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি বিশ্বস্ততার ভিত্তিতেই তার স্থান নির্ধারিত হবে। এভাবে দারিদ্র্য পীড়িত আরবদের বিপর্যস্ত অর্থনৈতিক জীবনযাত্রা সুষ্ঠু গতিপথ খুঁজে পায়।

রাজস্ব ব্যবস্থাঃ হজরত মুহাম্মাদ (সা.) এর জীবিত কালে নিম্নলিখিত উৎস থেকে রাজস্ব আদায় করতেন। যেমন: (ক) আল-গণিমাত (যুদ্ধলব্ধ দ্রব্যাদি) (খ) যাকাত, (গ) জিজিয়া, (ঘ) খারাজ (ভূমি রাজস্ব বা কর), (ঙ) আলফাই (রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি)।

১। গণিমাহ বা যুদ্ধ-লব্ধ দ্রব্যাদি: অস্ত্র-শস্ত্র এবং অন্যান্য অবস্থাবর সম্পত্তিই যুদ্ধলব্ধ দ্রব্যাদির অন্তর্ভুক্ত। যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রু কর্তৃক পরিত্যক্ত এই সমস্ত অস্ত্র-শস্ত্র ও রসদপত্র অধিকার করে নেওয়া হত। যুদ্ধবন্দী কাফেরগণকে যুদ্ধলব্ধ দ্রব্যের অন্তর্ভুক্ত করা হতো। উক্ত বন্দীদেরকে মুসলমান সৈন্যের দাস হিসেবে বিতরণ করা হতো। যুদ্ধলব্ধ দ্রব্যের চার-পঞ্চামাংশ যোদ্ধাগণের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া হত এবং অবশিষ্ট এক-পঞ্চমাংশ হজরত মুহাম্মাদ (সা.) এর জন্য নির্ধারিত ছিল। এ অংশকে খুমুস বলা হয়।

২। যাকাতঃ কুরআন শরীফ নামাজের পরেই যাকাত প্রদানের নির্দেশ রয়েছে। সুতরাং প্রত্যেক সংগতিসম্পন্ন মুসলমানের একান্ত কর্তব্য দরিদ্রের মধ্যে বন্টন করার উদ্দেশ্য যাকাত প্রদান করা।
নিম্নলিখিত দ্রব্যাদির উপর যাকাত ধার্য করা হতো। যথা-
  • খাদ্য-শস্য, ফল-ফলাদি ও খেজুর।
  • উট, ভেড়া, মেষ, ছাগল, গো-মহিষ ইত্যাদি।
  • স্বর্ণ ও রৌপ্য এবং
  • বাণিজ্যিক দ্রব্যাদি ও নগদ অর্থ।
পূর্ণ এক বছরকালের জন্য সংসারের আবশ্যকীয় খরচাদি বাদ দিয়ে বাকি সম্পত্তির (নিসাব) উপর যাকাত ধার্য করা হয়। বিভিন্ন সম্পত্তির নিসাব বিভিন্ন রকম।

৩। জিজিয়া বা নিরাপত্তামূলক সামরিক কর: এই কর অমুসলমান প্রজাদের উপর ধার্য হতো। এর পরিবর্তে তাদেরকে যুদ্ধে যোগদান হতে রেহাই দেওয়া হতো এবং মুসলিম রাষ্ট্র তাদের জান-মালের নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণ করতো। অমুসলমানকে রক্ষা করতে না পারলে মুসলমানগণ তাদের প্রদত্ত জিজিয়া কর ফিরিয়ে দিত। মহানবি হজরত মুহাম্মাদ (সা.) এর জীবিত কালে প্রত্যেক সামর্থবান অমুসলিম প্রজাকে বাৎসরিক এক দিনার হিসাবে জিজিয়া কর দিতে হতো। জিজিয়া নতুন কর নয় পারস্য ও রোমান সাম্রাজ্যে যথাক্রমে গেজিট এবং ট্রাইবিউটম ক্যাপিটিস নামে পরিচিত ছিলো। আয়কৃত অর্থ সম্পূর্ণরূপে মুসলমান সৈন্যদের ব্যয়ভার নির্বাহের ক্ষেত্রে ব্যয় করা হতো।

৪। খারাজ: অমুসলমান প্রজাগণকে নিজ নিজ ভূখণ্ডের উপর খারাজ নামক এক প্রকার ভূমি-রাজস্ব প্রদান করতে হতো। উক্ত কর পারস্যে ও রোমান সাম্রাজ্যের যথাক্রমে খারাগ ও ট্রাইবিউটম সলি নামে পরিচিত ছিল।

৫। আলফাই: মহানবি হজরত মুহাম্মাদ (সা.) এর শাসনাধীনে আল-ফাই নামক কিছু রাষ্ট্রীয় ভূমি ছিল। রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি হতে আদায়কৃত অর্থ সম্পূর্ণভাবে জনসাধারণের কল্যাণের জন্য ব্যয় করা হতো।

বিদায় হজের ভাষণের প্রধান উক্তি কয়টি

বিদায় হজের ভাষণে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উক্তি রয়েছে, যা ইসলামের মৌলিক শিক্ষা ও নির্দেশনা বহন করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি উক্তি হলো:

১। হে মুসলমানগণ, স্মরণ রেখ, প্রতিটি কাজের জন্য তোমাদেরকে আল্লাহর নিকট উপস্থিত হয়ে জবাবদিহি করতে হবে।

২। হে সাহাবিগণ, সহধর্মিনীদের উপর তোমাদের যেরূপ অধিকার আছে, তোমাদেরও উপর তাদের অধিকার অনুরূপ। আল্লাহকে সাক্ষী রেখে তোমরা তাদেরকে গ্রহণ করেছো। তাদের প্রতি সবসময় সদয় ব্যবহার করবে।

৩। দাসদাসীদের সঙ্গে হৃদয়পূর্ণ ও আন্তরিক ব্যবহার করবে। তোমরা যা আহার কর, যা পরিধান কর, তাদেরকেও অনুরূপ খাদ্য ও বস্ত্র দান করবে। তারা যদি ক্ষমার অযোগ্য কোনো ব্যবহার করে তা হলেও তাদের মুক্তি দান করবে। স্মরণ রেখ, তারাও আল্লাহর সৃষ্টি এবং তোমাদের মতো মানুষ।

৪। স্মরণ রেখ, বাসভূমি ও বর্ণ-নির্বিশেষে প্রত্যেক মুসলমান সমান। আজ হতে বংশগত কৌলিন্য প্রথা বিলুপ্ত করা হলো। সেই তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ যে সৎকর্ম দ্বারা নিজের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে।

৫। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করবে না, পূর্বের অনেক জাতি এ কারণেই ধ্বংস হয়েছে। নিজ যোগ্যতা বলে ক্রীতদাস যদি নেতা হয় তার অবাধ্য হবে না। বরং তার আনুগত্য করবে।

৬। পথপ্রদর্শক হিসেবে তোমাদের জন্য আল্লাহর কালাম (কুরআন মাজিদ) ও তাঁর প্রেরিত সত্যের বাহক রাসুল করিমের চরিত্রাদর্শ (হাদিস) রেখে যাচ্ছি। যতদিন তোমরা কোরআন মাজিদ ও হাদিসের দেখানো পথে চলবে ততদিন তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না।

বিদায় হজকে কেন বিদায় হজ বলা হয়

বিদায় হজ ইসলাম ধর্মের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ও গভীর তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এই হজকে "বিদায় হজ" বলা হয় মূলত এই কারণে যে, এটি ছিল মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনের প্রথম এবং শেষ হজ। আর এ হজের কিছুদিন পরেই তিনি ইন্তেকাল করেন। ফলে, এ হজটি হয়ে ওঠে তার জীবনের শেষ হজ — যার মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর নবুয়তের পূর্ণতা ঘোষণা করেন এবং মুসলিম উম্মাহর জন্য রেখে যান একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা।

এটি ছিল একটি মহাসমাবেশ, যেখানে ইসলামের মূল শিক্ষাগুলোকে নবী করিম (সা.) সুস্পষ্টভাবে উপস্থাপন করেন। এই হজের মূল আকর্ষণ ছিল তাঁর প্রদত্ত বিখ্যাত ভাষণ, যা আমরা বিদায় হজের ভাষণ নামে চিনি। এ ভাষণে তিনি মানবাধিকার, নারীর মর্যাদা, সমাজের ন্যায়বিচার, অর্থনৈতিক ভারসাম্য, মুসলিম ভ্রাতৃত্ব, এবং কুরআনের অনুসরণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান করেন।
নবীজি (সা.) এ ভাষণে বলেন, "আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ করে দিলাম।" — এই ঘোষণার মাধ্যমে তিনি জানিয়ে দেন, ইসলাম এখন একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা হিসেবে সম্পূর্ণ হয়েছে এবং মুসলমানদের আর কোনো নতুন ওহির অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই।

এই হজ শুধুই একটি ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা ছিল না; এটি ছিল একটি বিপুল গুরুত্ববাহী বার্তা বহনকারী ঐতিহাসিক মুহূর্ত, যেখানে নবীজি (সা.) তাঁর উম্মাহকে সঠিক পথের দিশা দেখিয়ে গেছেন। তাই, বিদায় হজ কেবল একটি হজ নয়, বরং এটি ছিল একটি জীবন্ত দিকনির্দেশনার আলোকবর্তিকা যা যুগে যুগে মুসলমানদের পথ দেখিয়ে যাচ্ছে।

উপসংহার

প্রিয় পাঠক, আজকে আমি আপনাদের সাথে বিদায় হজের ভাষণ সম্পূর্ণ আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। আশা করি আপনি এই আর্টিকেলটি পুরো মনোযোগ সহকারে পড়েছেন এবং উপকৃত হতে পেরেছেন। এ রকম আরো তথ্য মূলক আর্টিকেল পেতে আমাাদের সাথেই থাকুন। আমরা সবসময় পাঠকের চাহিদা অনুযায়ী পোস্ট পাবলিশ করে থাকি। প্রিয় পাঠক, এই পোস্টটি পুরো মনোযোগ সহকারে পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url