বিদায় হজের ভাষণ সম্পূর্ণ জেনে নিন

মক্কা বিজয়ের পর দলে দলে লোক ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে। আরবের সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ইসলাম পৌঁছে যায়। হজরত মুহাম্মাদ (সা.) বুঝলেন আর বেশিদিন তাঁর পৃথিবীতে থাকা হবে না। তাই ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে (দশম হিজরিতে) হজ করার ইচ্ছা করলেন। এ উদ্দেশ্যে উক্ত সালের যিলকদ মাসে লক্ষাধিক সাহাবি নিয়ে হজরত মুহাম্মাদ (সা.) হজ করার উদ্দেশ্যে রওনা হন যা ইসলামের ইতিহাসে বিদায় হজ নামে পরিচিত। এ হজে রাসুল (সা.)-এর সহধর্মিণীগণও তাঁর সঙ্গে ছিলেন।
বিদায় হজের ভাষণ সম্পূর্ণ জেনে নিন
যুল হুলাইফা নামক স্থানে এসে সকলে ইহরাম ( হজের পোশাক) বেঁধে বাইতুল্লার উদ্দেশ্য রওনা হন। জিলহজ মাসের নবম তারিখে আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত জনসমুদ্রের উদ্দেশ্য মহানবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) ইতিহাসের এক যুগান্তকারী ভাষণ দেন। এ ভাষণে বিশ্ব মানবতার সকল কিছুর দিকনির্দেশনা ছিল। আরাফাতের ময়দানের পার্শ্বে ‘জাবালে রহমত’ নামক পাহাড়ে উঠে মহানবি হজরত মুহাম্মাদ (সা.) প্রথমে আল্লাহর প্রশংসা করলেন। অতঃপর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন যা বিদায় হজের ভাষণ নামে পরিচিত।

বিদায় হজের ভাষণ

১। হে মানব সকল! আমার কথা মনোযোগ সহকারে শোনবে। কারণ আগামী বছর আমি তোমাদের সাথে এখানে সমবেত হতে পারব কিনা জানি না।

২। আজকের এই দিন, এ স্থান, এ মাস যেমন পবিত্র, তেমনই তোমাদের জীবন ও সম্পদ পরস্পরের নিকট পবিত্র।

৩। মনে রাখবে অবশ্যই একদিন সকলকে আল্লাহর সামনে উপস্থিত হতে হবে। সেদিন সকলকে নিজ নিজ কাজের হিসাব দিতে হবে।

৪। হে বিশ্ববাসীগণ! স্ত্রীদের সাথে সদয় ব্যবহার করবে। তাদের উপর তোমাদের যেমন অধিকার আছে তেমনই তোমাদের উপরও তাদের অধিকার আছে।

৫। সর্বদা অন্যের আমানত রক্ষা করবে এবং পাপ কাজ থেকে রিত থাকবে ও সুদ থেকে দূরে থাকবে।

৬। আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করবে না। আর অন্যায়ভাবে একে অন্যকে হত্যা করবে না।

৭। মনে রেখ! দেশ, বর্ণ-গোত্র, সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল মুসলমান সমান। আজ থেকে বংশগত শ্রেষ্ঠত্ব বিলুপ্ত হলো। শ্রেষ্ঠত্বের একমাত্র মাপকাঠি হলো আল্লাহভীতি ও সৎকর্ম। সে ব্যক্তিই সবচাইতে সেরা, যে নিজের সৎকর্ম দ্বারা শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে।

৮। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করবে না, পূর্বের অনেক জাতি এ কারণেই ধ্বংস হয়েছে। নিজ যোগ্যতা বলে ক্রীতদাস যদি নেতা হয় তার অবাধ্য হবে না। বরং তার আনুগত্য করবে।

৯। দাস-দাসীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করবে। তোমরা যা আহার করবে ও পরিধান করবে তাদেরকেও তা আহার করাবে ও পরিধান করাবে। তারা যদি কোনো অমার্জনীয় অপরাধ করে ফেলে, তবে তাদের মুক্ত করে দেবে, তবুও তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করবে না। কেননা তারও তোমাদের মতোই মানুষ, আল্লাহর সৃষ্টি। সকল মুসলিম একে অন্যের ভাই এবং তোমরা একই ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ।

১০। জাহেলি যুগের সকল কুসংস্কার ও হত্যার প্রতিশোধ বাতিল করা হলো। তোমাদের পদ প্রদর্শনের জন্য আল্লাহর বাণী এবং তাঁর রাসুলের আদর্শ রেখে যাচ্ছি। এগুলো যতদিন তোমরা আঁকড়ে থাকবে ততদিন তোমরা বিপথগামী হবে না।

১১। আমিই শেষ নবি। আমার পর কোনো নবী আসবে না এই পৃথিবীতে।

১২। তোমরা যারা উপস্থিত আছো তারা অনুপস্থিতদের কাছে আমার বাণী পৌঁছে দেবে।

তারপর হজরত মুহাম্মাদ (সা.) আকাশের দিকে তাকিয়ে আওয়াজ করে বলতে লাগলেন, হে আল্লাহ! আমি কি তোমার বাণী সঠিকভাবে তোমার বান্দাদের নিকট পৌঁছাতে পেরেছি? সাথে সাথে উপস্থিত জনসমুদ্র থেকে আওয়াজ এলো হ্যাঁ। নিশ্চয়ই পেরেছেন। অতঃপর হজরত মুহাম্মাদ (সা.) বললেন, হে আল্লাহ তুমি সাক্ষী থাক। এরপরই আল্লাহ তায়ালা কোরআনের আয়াত নাজিল করলেন এবং বললেন, আজ আমি তোমাদের ধর্মকে পূণাঙ্গ করে দিলাম এবং আমার নিয়ামত তোমাদের জন্য পরিপূর্ণ করে দিলাম। ইসলামকে তোমাদের পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা হিসেবে মনোনীত করলাম। (সূরা আলা-মায়িদা, আয়াত ৩)।

মহানবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) কিছুক্ষণ নীরব থাকলেন। জনতাও নীরব থাকল। অতঃপর সকলের দিকে করুণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ‘আল বিদা’ (বিদায়)। একটা অজানা বিয়োগ-ব্যাথা উপস্থিত সকলের অন্তরকে ভারাক্রান্ত করে তুলল।

মহানবি হজরত মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর ভাষণের মাধ্যমে যে দিকনির্দেশনা তুলে ধরেছিলেন বাস্তব জীবনে তিনি তা অনুশীলন করেছেন। আমরাও আমাদের ভাষণে বা বক্তব্য যা বলব জীবনে তা অনুশীলন করব। তাহলে আমাদের দেশ ও জাতি আরও সুন্দর, সমৃদ্ধ ও উন্নত হবে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url