বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনী জেনে নিন

প্রিয় পাঠক, আজকে আমি আপনাদের সাথে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনী নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো। আশা করি আপনি এই পোস্টটি পুরো মনোযোগ সহকারে পড়বেন। আপনি যদি এই পোস্টটি পুরো মনোযোগ সহকারে পড়েন তাহলে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনী সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন। প্রিয় পাঠক, চলুন বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনী জেনে নিন
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাঙ্গালি কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, দার্শনিক, বাংলা কাব্য, অগ্রগামী ইত্যাদি ভূমিকার জন্য সর্বাধিক পরিচিত। বাংলা ভাষার অন্যতম সাহিত্যিক, দেশপ্রেমী এবং বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিবেবে পরিচিত কাজী নজরুল ইসলাম। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ এই দুই বাংলাতেই তাঁর কবিতা ও গান সমানভাবে সমাদৃত। তাঁর কবিতায় বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাঁকে বিদ্রোহী কবি বলা হয়। 

তার কবিতার মূল বিষয়বস্তু ছিল মানুষের প্রতি মানুষের অত্যাচার, নিপীড়ন এবং দাসত্বের বিরুদ্ধে সোচ্চার ও প্রতিবাদ। বাঙ্গালির মনে কাজী নজরুল ইসলামের মর্যাদা ও গুরুত্ব অপরসীম। একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সংঙ্গীজ্ঞ, সাংবাদিক রাজনীতিবিদ এবং সৈনিক হিসেবে অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে নজরুল সর্বদাই ছিলেন সোচ্চার। তাঁর কবিতা ও গানে এই মনোভাবই প্রতিফলিত হয়েছে।

জন্ম ও প্রাথমিক জীবন

১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ মে (১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ) ভারতের পশ্চিম বঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহন করেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। চুরুলিয়া গ্রামটি আসানসোল মহকুমার জামুরিয়া থানায় অবস্থিত। কাজী নজরুল ইসলামের মায়ের নাম হলো জাবেদা খাতুন। কাজী নজরুল ইসলামের পিতা ছিলেন একজন মসজিদের ইমাম। তারা ছিলেন তিন ভাই বোন। তার সহোদর তিন ভাই ও দুই বোনের নাম হলো সবার বড় কাজী সাহেবজান, কনিষ্ঠ কাজী আলী হোসেন, বোন উম্মে কুলসুম। কাজী নজরুল ইসলামের ডাক নাম ছিল দুখু মিয়া। 
তিনি স্থানীয় মক্তবে (মসজিদে পরিচালিত মুসলিমদের ধর্মীয় স্কুল) কুরআন, ইসলাম ধর্ম, দর্শন এবং ইসলামি দর্মতত্ব অধ্যায়ন শুরু করেন। ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে যখন তার পিতার মৃত্যু হয়, তখন তার বয়স ছিল মাত্র নয় বছর। পারিবারিক অভাব অনটনের কারণে তাঁর শিক্ষা বাধাগ্রস্ত হয় এবং মাত্র দশ বছর বয়সে তাকে নেমে যেতে হয় জীবিকার সন্ধানে। এ সময় নজরুল মক্তব থেকে নিম্ন মাধ্যমিক পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উক্ত মক্তবেই শিক্ষকতা শুরু করেন। একই সাথে হাজী পালোয়ানের কবরের সেবক এবং মসজিদের মুয়াজ্জিন (আজান দাতা) হিবেবে কাজ শুরু করেন। 

এই সব কাজের মাধ্যমেই তিনি অল্প বয়সেই ইসলাম ধর্মের মৌলিক আচার অনুষ্ঠানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হবার সুযোগ পান। যা তার পরবর্তীতে সাহিত্য কর্মকে বিপুল ভাবে প্রভাবিত করেছে। তিনিই বাংলা সাহিত্য ইসলামী চেতনার চর্চা শুরু করেছেন বলে আখ্যায়িত করা যায়। মক্তব, মসজিদ ও মাজারের কাজে নজরুল বেশি দিন ছিলেন না। বাল্য বয়সেই লোকশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে একটি লেটো (বাংলার রাঢ় অঞ্চলের কবিতা, গান ও নৃত্যের মিশ্র আঙ্গিক চর্চার ভ্রাম্যমান নাট্যদল) দলে যোগ দেন। 

তার চাচা কাজী বজলেকরিম চুরুলিয়া অঞ্চলের লেটো দলের বিশিষ্ট ওস্তাদ ছিলেন এবং আরবি, ফারসি ও উর্দূ ভাষায় তার দখল ছিল। এছাড়া বজলে করিম মিশ্র ভাষায় গান রচনা করতেন।ধারণা করা হয় বজলে করিমের প্রভাবেই নজরুল লেটো দলে যোগ দিয়েছিলেন। এছাড়া ঐই অঞ্চলের জনপ্রিয় লেটো কবি শেখ চকর এবং কবিয়া বাসুদেবের লেটো ও কবি গানের আসরে নজরুল নিয়মিত অংশ নিতেন। লেটো দলেই সাহিত্যচর্চা শুরু হয়। এই দলের সাথে তিনি বিভিন্ন স্থানে যেতেন, তাদের সাথে অভিনয় শিখতেন এবং তাদের নাটকের জন্য গান ও কবিতা লিখতেন। 

নিজ কর্ম বরং অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বাংলা এবং সংস্কৃত সাহিত্য অধ্যয়ন শুরু করেন। একই সাথে হিন্দু ধর্মগ্রন্থ অর্থাৎ পুরান সমূহ অধ্যায়ন করতে থাকেন। সেই অল্প বয়সেই তার নাট্য দলের জন্য বেশ কিছু লোকসংগীত রচনা করেন। এর মধ্যে রয়েছে চাষার সঙ,শকুনিবধ,রাজা যুধিষ্ঠের সঙ, দাতা কর্ণ, আকবর বাদশা, কবি কালিদাস, রাজপুত্রের গান, বড় শালিকের ঘাড়ে রোঁ এবং মেঘনাথ বধ। একদিকে মসজিদ, মাজার ও মক্তব জীবন, অপরদিকে লেটো দলের বিচিত্র অভিজ্ঞতা নজরুলের সাহিত্যিক জীবনের অনেক উপাদান সরবরাহ করেছে। 

নজরুলের এ সময়কার কবিতার উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে আমি আল্লাহ নামের বীজ বুনেছি, এবার মনের মাঠে ফলবে ফসল বেচব তারে কেয়ামতের হাটে। ১৯১০ সালে নজরুল লেটো দল ছেড়ে ছাত্র জীবনে ফিরে আসেন। লেটো দলে তার প্রতিভায় সকলেই যে মুগ্ধ হয়েছিল তার প্রমাণ নজরুল লেটো ছেড়ে আসার পর তাকে নিয়ে অন্য শীর্ষদের রচিত গান আমরা এই অধীন, হয়েছি ওস্তাদ হীন/ ভাবি তাই নিশি দিন, বিষাদ মনে/ নামতে নজরুল ইসলাম, কি দিব গুণের প্রমাণ। কাজী নজরুল ইসলামের নতুন ছাত্র জীবনে প্রথম স্কুল ছিল রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুল। 

এর পর ভর্তি হন মাথারুণ উচ্চ ইংরেজি স্কুলে যা পরবর্তীতে নবীনচন্দ্র ইনস্টিটিউশন নামে পরিচিত লাভ করে। মাথরুণ স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক ছিলেন কুমুদোরঞ্জন মল্লিক যিনি সেকালের বিখ্যাত কবি হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। তার সান্নিধ্য নজরুলের অনুপ্রেরণার একটি উৎস সে প্রধান শিক্ষক স্মৃতিচারণ করতে যেয়ে নজরুল সম্বন্ধে লিখেছেন, ছোট সুন্দর ছনমনে ছেলেটি, আমি ক্লাস পরিদর্শন করতে গেলে সে আগেই প্রমাণ করিত। আমি হাসিয়া তাহাকে আদর করিতাম। সে বড় লাজুক ছিল। যা হোক আর্থিক সমস্যা তাকে বেশি দিন এখানে পড়াশোনা করতে দেয়নি। 

ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর তাকে আবার কাজে ফিরে যেতে হয়। প্রথমে যোগ দেন বাসুদেবের কবি দলে। এরপর একজন খ্রিস্টান রেলওয়ে গার্ডের খানসামা এবং সবশেষে আসানসোলের চা রুটি দোকানে রুটি বানানোর কাজ নেন। এভাবে বেশ কষ্টের মাঝেই তার অতিবাহিত হয় বাল্য জীবন।এই দোকানে কাজ করার সময় আসানসোলের দারোগা রফিজউল্লার সাথে তার পরিচয় হয়। দোকানে একা একা বসে নজরুল যেসব কবিতা ও ছড়া রচনা করতেন তা দেখে রফিজউল্লাহ তার প্রতিভার পরিচয় পান। 

তিনিই নজরুলকে ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেনীতে ভর্তি করিয়ে দেন। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি আবার রানীগঞ্জের সিয়ালসোল রাজ স্কুলে ফিরে যান এবং সেখানে অষ্টম শ্রেণী থেকে পড়াশোনা করে শুরু করেন। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত তিনি এখানেই পড়াশোনা করেন।

১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে মাধ্যমিকের প্রি টেস্ট পরীক্ষা না দিয়ে তিনি সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন। এই স্কুলে অধ্যয়নকালে নজরুল এখানকার চারজন শিক্ষক দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। এরা হলেন সংগীতের সতীশ চন্দ্র কাঞ্জিলাল, বিপ্লবী চেতনা বিশিষ্ট নিবারণ চন্দ্র ঘটক, ফারসি সাহিত্যের হাফিজ নুরুন্নবী এবং সাহিত্য চর্চায় নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।

সৈনিক জীবন

১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে নজরুল সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। প্রথমে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে এবং পরবর্তীতে প্রশিক্ষণের জন্য সীমান্ত প্রদেশের নওশেরায় যান। প্রশিক্ষণ শেষে করাচি সেনা নিবাসে সৈনিক জীবন কাটাতে শুরু করেন। তিনি সেনাবাহিনীতে ছিলেন ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের শেষভাগ থেকে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের মার্চ এপ্রিল পর্যন্ত, অর্থাৎ প্রায় আড়াই বছর। এই সময়ের মধ্যে তিনি ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাধারণ সৈনিক থেকে কোয়াটার মাস্টার হাবিলদার পর্যন্ত হয়েছিলেন। 

উক্ত রেজিমেন্টের পাঞ্জাবি মৌলবীর কাছে তিনি ফারসি ভাষা শিখেন। এছাড়া সহ সৈনিকের কাছে বা সহ-সৈনিকদের সাথে দেশে-বিদেশী বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র সহযোগে সংগীতের চর্চায অব্যাহত রাখেন। আর গদ্য-পদ্যের চর্চাও চলতে থাকে একই সাথে। করাচি সেনানিবাসে বসে নজরুল যে রচনাগুলো সম্পন্ন করেছেন তার মধ্যে রয়েছে মুক্তি,ব্যাথার দান, ঘুমের ঘোরে, কবিতা সমাধি ইত্যাদি। 

এই করাচি সেনানিবাসে থাকা সত্ত্বেও তিনি কলকাতার বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকার গ্রাহক ছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে প্রবাসী, ভারত বর্ষ, ভারতী মানসী সবুজপত্র ইত্যাদি। এই সূত্রে বলা যায় নজরুলের সাহিত্য চর্চার হাতে খড়ি হয় করাচি সেনানিবাসেই। সৈনিক থাকা অবস্থায় তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন। এ সময় নজরুলের বাহিনীর ইরাক যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যুদ্ধ থেমে যাওয়ার কারণে আর যেতে হয়নি তাদের। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে যুদ্ধ শেষ হলে ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্টে ভেঙে দেওয়া হয়। এরপর তিনি সৈনিক জীবন ত্যাগ করে কলকাতায় ফিরে আসেন।

সাংবাদিক জীবন

জীবন ও বিয়ে যুদ্ধ শেষে কলকাতায় এসে নজরুল ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে বসবাস শুরু করেন। তার সাথে থাকতেন এই সমিতির অন্যতম কর্মকর্তা মোজাফফর আহমেদ। এখান থেকেই তার সাহিত্য সাংবাদিকতা জীবনের মূল কাজগুলো শুরু হয়। প্রথম দিকেই মোসলেম ভারত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, উপাসনা প্রভৃতি পত্রিকায় তার কিছু লেখা প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে রয়েছে উপন্যাস বাধনহারা এবং কবিতা বোধন,সাত-ইল-আরব, বাদল প্রাতেরশরাব, আগমনী, খেয়া-পায়ের তরণী, কোরবানি, মোহরম, ফাতেহা-ই-দোয়াজদম। 

এই লেখা গুলো সাহিত্য ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে প্রশংসিত হয়। এরপেক্ষিতে কবি ও সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার মসলেম ভারত পত্রিকায় তার খেয়া-পায়ের তরুণী এবং বাদল প্রাতের সরাব কবিতা দুটির প্রশংসা করে একটি সমালোচনা প্রবন্ধ লিখেন। এ থেকেই দেশের বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও সমালোচকদের সাথে নজরুলের ঘনিষ্ঠ পরিচয় শুরু হয়। বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে কাজী মোতাহার হোসেন, মোজাম্মেল হক, কাজী আব্দুল ওদুদ, মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, আফজালুল হক এর সাথে পরিচয় হয়। 

তৎকালীন কলকাতা দুটি জনপ্রিয় সাহিত্যিক আসর গজেনদার আড্ডা এবং ভারতীয় আড্ডায় অংশগ্রহণের সুবাদে পরিচিত হন অতুল প্রসাদ সেন, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দনাথ দত্ত, প্রেমাক্কুর আতথী, শিশিরভাদুরি, শরৎচন্দ্রচট্টেপাধ্যায়, নির্মেলন্দু লাহিড়ী, চারুচন্দ্রচট্টেবন্দ্যোপাধ্যায়, ওস্তাদ করমতুল্লা খাঁ প্রমুখের সাথে। ১৯২১ সালের অক্টোবর মাসে তিনি শান্তিনিকেতনে যে রবীন্দ্রনাথের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তখন থেকে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু পর্যন্ত তাদের মধ্যে সু সম্পর্ক বজায় ছিল। 

কাজী মোতাহার হোসেনের সাথে নজরুলের বিশেষ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের জুলাই ১২ই তারিখে নবযুগ নামে একটি সান্ধ্য দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হওয়া শুরু করে। অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে প্রকাশিত এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন শেরেবাংলা একে ফজলুল হক। এই পত্রিকার মাধ্যমে নজরুল নিয়মিত সাংবাদিকতা শুরু করেন। ঐই বছরইএ পত্রিকায় মহাজেরিন হত্যার জন্য দায়ী কে? শিরোনাম একটি প্রবন্ধ লিখেন যার জন্য পত্রিকার জামানত বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং নজরুলের উপর পুলিশের নজরদারি শুরু হয়। 

যাই হোক সাংবাদিকতার মাধ্যমে তিনি তৎকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পান। একই সাথে মোজাফফর আহমেদের সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা সমিতিতে যোগদানের মাধ্যমে রাজনীতি বিষয়ে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পেয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। বিভিন্ন ছোটখাট অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কবিতা ও সংগীত চর্চার ছিল তার সুবর্ণ সুযোগ। তখনও তিনি নিজে গান লিখে সুর দিতে শুরু করেন নি। 

পরবর্তীতে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত কবিতা বিদ্রোহী প্রকাশিত হয়। এবং সারাদেশে ভারতের সাহিত্য সমাজে খ্যাতি লাভ করে। এই কবিতায় নজরুল নিজেকে বর্ণনা করেন আমি বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির গৃহ হারা যত পথিকের, আমি অবমানিতের মরণ বেদনা, বিষ জ্বালা, চির লাঞ্ছিত বুকে গতি ফের আমি অভিমানী চির ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যথা সু নিবিড়, চিত চুম্বন চোর-কম্পন আমি থর-থর-থর প্রথম প্রকাশ কুমারির ! আমি পোপন প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল করে দেখা অনুখন, আমি চপল মেয়ের ভালোবাসা তার কাকন চুড়ির কন-কন। 

আমি চির বিদ্রোহী বীর-বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির উন্নত শির!। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই আগষ্ট নজরুল ধূমকেতু পত্রিকা প্রকাশ করে। এটি সপ্তাহের দুই বার প্রকাশিত হতো। ১৯২০ এর দশকে অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলন এক সময় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এর পরপর স্বরাজ গঠনে যে সশস্ত্র বিল্পববাদের আবির্ভাব ঘটে তাতে ধূমকেতু পত্রিকার বিশেষ অবদান ছিল। এই পত্রিকাকে আশীর্বাদ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু, আয় চলে আয় রে ধূমকেতু। আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন। 

পত্রিকার প্রথম পাতার শীর্ষে এই বাণী লিখা থাকতো। পত্রিকার ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯২২ সংখ্যায় নজরুলের কবিতা আনন্দময়ীর আগমনে প্রকাশিত হয়। এই রাজনৈতকি কবিতা প্রকাশিত হওয়ায় ৮ নভেম্বর পত্রিকার উক্ত সংখ্যাটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। একই বছরের ২৩ নভেম্বের তার যুগবাণী প্রবন্ধগ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং একইদিনে তাকে কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর তাকে কুমিল্লা থেকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের ৭ জানুয়ারি নজরুল বিচারাধীন বন্দী হিসেবে আত্মপক্ষ সমর্থন করে এক জবানবন্দী প্রদান করেন। চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহোর আদালতে এই জবানবন্দী দিয়েছিলেন।

তার এই জবানবন্দি বাংলা সাহিত্য রাজ বন্দির জবানবন্দী নামে বিশেষ সাহিত্যিক মর্যাদা লাভ করেছে। এই জবানবন্দিতে নজরুল বলেছেন আমার উপর অভিযোগ, আমি রাজ বিদ্রোহী। তাই আমি আজ রাজ কারাগারে বন্দী এবং রাজদ্বারে অভিযুক্ত। আমি কবি, আমি অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করার জন্য অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তিদানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত। কবির কণ্ঠে ভগবান সাড়াদেন, আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা ভগবানের বাণী। সে বাণী রাজ বিচারের রাজদ্রোহী হতে পারে, কিন্তু ন্যায় বিচারে সে বাণী ন্যায়দ্রোহী নয়, সত্যাদ্রোহী নয়। সত্যের প্রকাশ নিরুদ্ধ হবে না। 

আমার হাতের ধূমকেতু এবার ভগবানের হাতের অগ্নি-মশাল হয়ে অন্যায় অত্যাচার দগ্ধ করবে। ১৬ই জানুয়ারি বিচারের পর নজরুলকে এক বছরের সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয়। এখানে যখন বন্দী জীবন কাটাচ্ছিলেন তখন ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি ২২ বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বসন্ত গীতিনাট্য গ্রন্থটি নজরুলকে উৎসর্গ করেন। এতে নজরুল বিশেষ উল্লসিত হন। 

এই আনন্দে জেলে বসে আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কবিতাটি রচনা করেন। এভাবেই কাজী নজরুল ইসলাম অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন। তাই কাজী নজরুল ইসলামকে বিদ্রোহী কবি বলা হয়। বাংলা সাহিত্যের সকল শাখায় তিনি প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি, গজল, খেয়াল ও রাগ প্রধান গান রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেছেন। আরবি-ফারসি শব্দের সার্থক ব্যবহার তাঁর কবিতাকে বিশিষ্টতা দান করেছে।

কাজী নজরুল ইসলামের শেষ জীবন

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর অসুস্থ কবিকে ঢাকায় আনা হয়। এবং পরে তাঁকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। তাঁকে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় কবির মর্যাদায় ভূষিত করা হয়। তাঁর রচিত কাব্যগুলোর মধ্যে অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশি, ছায়ানট, প্রলয়শিখা, চক্রবাক, সিন্ধুহিন্দোল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। 

২৯ আগষ্ট ১৯৭৬ সালে কবি ঢাকার পি.জি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদ সংলগ্ন প্রাঙ্গণে তাকেঁ তার অসীয়ত অনুযায়ী তাঁকে পরিপূর্ণ সামরিক মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। তিনি মৃত্যেুর আগে বলেছিলেন মসজিদের পাশে যেন আমার কবর দিও ভাই। তাই তাকে মসজিদের পাশে কবর দেওয়া হয়।

উপসংহার

প্রিয় পাঠক, আজকে আমি আপনাদের সাথে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনী নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। আশা করি আপনি এই পোস্টটি পুরো মনোযোগ সহকারে পড়েছেন। এবং উপকৃত হতে পেরেছেন। এ রকম আরো তথ্য মূলক পোস্ট পড়তে আমাদের সাথেই থাকুন। আমরা সবসময় পাঠকের চাহিদা অনুযায়ী পোস্ট পাবলিশ করে থাকি। এই পোস্টটি পুরো মনোযোগ সহকারে পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url