১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সঠিক ইতিহাস জেনে নিন

প্রিয় পাঠক, আজকে আমি আপনাদের সাথে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এই টপিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো। আশা করি আপনি এই পোস্টটি পুরো মনোযোগ সহকারে পড়বেন। আপনি যদি এই পোস্টটি পুরো মনোযোগ সহকারে পড়েন তাহলে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান সম্পর্কে সঠিক ইতিহাস বিস্তারিত জানতে পারবেন। প্রিয় পাঠক, চলুন বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।

১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান

১৯৬৮ সালের নভেম্বর মাসে ছাত্র অসন্তোষকে কেন্দ্র করে যে আন্দোলন দানা বাঁধে তা একসময় ছড়িয়ে পড়ে শহর ও গ্রামের শ্রমিক-কৃষক ও সাধারণ মানুষের মাঝে। পাকিস্থানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে এক দুর্বার আন্দোলন, যা ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান হিসেবে পরিচিত। আইয়ুব খানের পতনকে কেন্দ্র করে পাকিস্থানের দুই অংশের মানুষ প্রথমবারের মতো একসাথে আন্দোলনে নামে।
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সঠিক ইতিহাস জেনে নিন
পাকিস্থান জন্মের পর থেকেই পূর্ব পাকিস্থানের প্রতি জাতিগত নিপীড়ন, বঞ্চনা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে ওঠে। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টিতে সেগুলো প্রত্যক্ষ প্রভাব রেখেছিল। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ছিল পাকিস্থান প্রতিষ্ঠার পরবর্তীকালের সবচেয়ে বড় আন্দোলন।

১৯৬৮ সালের নভেম্বর মাসের ছাত্র অসন্তোষ মাওলানা ভাষানীতিতে গণঅভ্যুত্থানেপরিণত হয়। ৬ ডিসেম্বর জুলুম প্রতিরোধ দিবস পালনের জন্য ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক ফেডারেশন ও পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সমিতি যৌথ কর্মসূচি হিসেবে পল্টন ময়দানে একটি জনসভার আয়োজন করে। জনসভার পর একটি বিরাট মিছিল গভর্নর হাউস ঘেরাও করে। সেখানে মিছিল কারীদের সাথে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ হলে মাওলানা ভাসানী ঢাকা শহরে হরতাল আহবান করেন। 

৮ই ডিসেম্বরবিরোধী দলগুলোর ডাকে গোটা পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল পালিত হয়। দশে ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস পালন করে। ২৯ শে ডিসেম্বর ঘেরাও আন্দোলন সূচনা হয়। ১৯৬৯ সালে চৌঠা জানুয়ারি পুরো পাকিস্তানে ছাত্র ইউনিয়ন, নেতৃত্ববৃন্দ মিলে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১১ দফা দাবি পেশ করে। অচিরেই ১১ দফা দাবিকে আপামর বাঙালি সমর্থন করে। ১৯৬৯ এ উত্তাল সময়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা দাবি ছিল খুবই সময়োপযোগী। 

ফলে এই দ্রুত কর্মসূচি কে কেন্দ্র করে বিরোধী দলগুলোর ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ৮ই জানুয়ারি পাকিস্তানের আটটি রাজনৈতিক দল মিলে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে এবং আট দফা দাবি পেশ করে। এরপর থেকে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের যৌথ উদ্যোগে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক গণ-আন্দোলন গড়ে ওঠে। ২০ জানুয়ারি পুলিশে নির্যাতনের প্রতিবাদে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ধর্মঘট পালন করে। ২০শে জানুয়ারি নির্যাতনের প্রতিবাদে ছাত্ররা পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল পালন করে। হরতাল পালনকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান পুলিশের গুলিতে নিহত হন। 
আসাদের হত্যার প্রতিবাদে ২২, ২৩ ও ২৪ তারিখে ব্যাপক কর্মসূচি ঘোষিত হয়। ২৪ তারিখে সারা দেশে হরতাল চলাকালে সর্বস্তরের মানুষের ব্যাপক ঢল নামে। মানুষের অংশগ্রহণে আন্দোলন যেন গণঅভ্যুত্থানের রূপ নেয়। আবারও পুলিশের গুলিতে নবম শ্রেণীর ছাত্র কিশোর মতিউর নিহত হয় এবং অসংখ্য মানুষ আহত হয়। এরপর ক্ষিপ্ত জনতা সরকারি পত্রিকা দৈনিক পাকিস্তান ও মর্নিং নিউজ অফিসে আগুন লাগিয়ে দেয়। ঢাকা শহর সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। 

২৪ শে জানুয়ারির পর থেকে লাগাতার আন্দোলন ও হরতালে বহু মানুষ পুলিশ ও সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত ও আহত হয়। ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ঐতিহাসিক আগরতলা মামলার অন্যতম অভিযুক্ত সার্জেন্ট জরুল হককে নৃশংস ভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়। জহরুল হকের হত্যার প্রতিবাদে ১৬ই ফেব্রুয়ারি আন্দোলন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। জনতা আগরতলা মামলার বিচারপতির বাসভবনে আগুন ধরিয়ে দেয়। 

বিকেলে এক জনসভায় মাওলানা ভাসানী ঘোষণা দেন, ২ মাসের মধ্যে ১১ দফা দাবি বাস্তবায়ন ও রাজবন্দীদের মুক্তি দিতে হবে। প্রয়োজন হলে ফরাসি বিপ্লবের মত জেল ভেঙ্গে নেতাকর্মীকে মুক্ত করে আনা হবে। অবস্থা বেগতিক দেখে সরকার ঢাকায় কারফিউ জারি করে ১৮ ফেব্রুয়ারি সেনাবাহিনী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের Proctor dr. শামসুজ্জোহা কে বেয়োনেট চার্জ করে হত্যা করে।

১৮ই ফেব্রুয়ারীর পর থেকে আন্দোলন আরো বেগবান হলে দেশের সার্বিকির পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি ঘটে। অবশেষে আইয়ুব খান বিরোধী দলের নেতাদের নিয়ে গোল টেবিল বৈঠক আহ্বান করলে নেতারা তা প্রত্যাখ্যান করেন। আরব খান বুঝতে পারেন, আগরতলা মামলা প্রত্যাহার ও অভিযুক্তদের মুক্তি না দিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। অবশেষে গণঅভ্যুত্থানের চাপে একুশে ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান ঘোষণা দেন, পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি আর প্রার্থী হবেন না। 

ঐতিহাসিক আগরতলা মামলা থেকে বঙ্গবন্ধু সহ ৩৫ জন নেতাকর্মী ছাড়া পান। ২৩ শে ফেব্রুয়ারির সংবর্ধনা সভায় বঙ্গবন্ধু ১১ দফা দাবির প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন। ২৬ শে ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খানের সাথে গোলটেবিল বৈঠক হয় বৈঠকে ছয় দফা ও ১১ দফার প্রশ্নে অটল থাকেন নেতা কর্মীরা। এদিকে পশ্চিম পাকিস্থানেও আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে। গোলটেবিল বৈঠকের আলোচনা বারবার ব্যর্থ হতে থাকে। পুরো দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। মার্চ মাসে সেনাবাহিনীর গুলিতে ৯০ জন নিহত হয়। 

অবশেষে ১০ই মার্চের বৈঠকে আইয়ুব খান সংসদীয় পদ্ধতি প্রবর্তন ও প্রাপ্তবয়স্ক দের ভোটাধিকার ভিত্তিতে নির্বাচনের কথা ঘোষণা করেন। ২২ শে মার্চ আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্থানের গভর্নর মোনায়েম খানকে অপসারণ করেন। তাতেও গণ আন্দোলন থামানো যায়নি। ২৫ শে মার্চ আইয়ুব খান সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। এভাবে পূর্ব পাকিস্থানে আইয়ুববিরোধী গণঅভ্যুত্থান সফলতা অজর্ন করে। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে গ্রাম ও শহরের কৃষক ও শ্রমিকদের মাঝে শ্রেনি চেতনার উন্মোষ ঘটে। পূর্ব পাকিস্থানের জনগণের মধ্যে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্কা বৃদ্ধি পায়।

১৯৬৯ সালের প্রথম শহীদ কে ছিলেন?

শহীদ আসাদুজ্জামান ছিলেন ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের প্রথম শহীদ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অবিস্মরণীয় নাম। তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ছিলেন এবং পাকিস্তানি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। আসাদ ১৯৬৯ সালের ১১ দফা আন্দোলনের অন্যতম নেতা ছিলেন, যা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিচালিত হয়েছিল।

১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি, ঢাকা শহরে ছাত্রদের নেতৃত্বে একটি প্রতিবাদ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়, যার নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন আসাদ। এই মিছিল ছিল তৎকালীন স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের শাসনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদের অংশ। মিছিলটি যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে পৌঁছায়, তখন পুলিশ মিছিলে গুলি চালায়। পুলিশের গুলিতে আসাদুজ্জামান গুরুতর আহত হন এবং সেখানেই শহীদ হন। তার এই আত্মত্যাগ পুরো দেশকে শোকাবিষ্ট করে তোলে এবং গণআন্দোলনে নতুন উদ্দীপনা যোগ করে।

শহীদ আসাদুজ্জামানের আত্মত্যাগ তৎকালীন ছাত্র আন্দোলনকে শক্তিশালী করে এবং জনগণের মধ্যে শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দেয়। তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ঢাকা শহরের একটি জায়গার নামকরণ করা হয়েছে "শহীদ আসাদ গেট"। তার মৃত্যু ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানকে ত্বরান্বিত করে এবং পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। শহীদ আসাদের নাম আজও আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে অমর হয়ে আছে।

১১ দফা আন্দোলন

১৯৬৮-৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্থানে আইয়ুববিরোধী গণআন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয়। এ অবস্থায় ছাত্ররা আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করে, যা গণঅভ্যুত্থানে রুপ নেয়। ১৯৬৯ সালের ৪ঠা জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম কার্যালয়ে ছাত্র ইউনিয়ন এবং ডাকসুর যৌথ উদ্যোগে তৎকালীন ডাকসুর সহসভাপতি তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১১ দফা দাবি নিয়ে গনঅভ্যুত্থানের ডাক দেয়। এ কর্মসূচি শুধু ছাত্রদের নয়, আপামর জনগণের আন্দোলনে অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করে।

উপসংহার

প্রিয় পাঠক, আজকে আমি আপনাদের সাথে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সঠিক ইতিহাস এই টপিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। আশা করি আপনি এই পোস্টটি পুরো মনোযোগ সহকারে পড়েছেন। এ রকম আরো তথ্য মূলক পোস্ট পড়তে আমাদের সাথেই থাকুন। আমরা সবসময় পাঠকের চাহিদা অনুযায়ী পোস্ট পাবলিশ করে থাকি। এই পোস্টটি পুরো মনোযোগ সহকারে পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url