পানি দূষণের কারণ ও প্রতিকার জেনে নিন
পানির সাথে বিভিন্ন বিষাক্ত পদার্থ মিশ্রিত হয়ে যদি পানির প্রাকৃতিক, রাসায়নিক ও জৈবিক বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন হয় এবং তার ফলে জলজ উদ্ভিদ, প্রাণী ও মানুষের অপূরণীয় ক্ষতি হয় বা তার আশঙ্কা থাকে তাকে পানি দূষণ বলে। বিভিন্ন কারণে পানি দূষিত হয়ে থাকে। কারণ গুলো নিচে উল্লেখ করা হলোঃ
পানি দূষণের কারণ
১। তেজস্ক্রিয় বর্জ্য পদার্থঃ বর্তমানে মানুষ তাদের ঘর উষ্ণ রাখা ও খাদ্য সংরক্ষণের জন্য, শিল্পের শক্তি ও গাড়ির জ্বালানি সরবরাহের জন্য বিভিন্ন ধরনের পরমাণু ও তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ ব্যবহার করে থাকে। পারমাণবিক চুল্লি ও অন্যান্য পারমাণবিক বিস্ফোরণের ফলে উদ্ভূত তেজস্ক্রিয় আইসোটোপগুলো উন্মুক্ত জলরাশিতে সহজেই মিশে গিয়ে উদ্ভিদ ও প্রাণীর ক্ষতিসাধন করে।
২। মড়ক ও আগাছা দমনকারী ওষুধঃ মানুষ উন্নতমানের বীজ, সার, উন্নত সেচ ব্যবস্থা ও বিভিন্ন ধরনের মড়ক, আগাছা ও পোকা দমনকারী ওষুধ ইত্যাদি ব্যবহার করে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির চেষ্টা করছে। এ ধরনের ওষুধসমূহ যখন উদ্ভিদের উপর ছড়ানো হয় তখন এগুলো মাটিস্থ পানির সাথে মিশে পানিকে দূষিত করে। এছাড়া ওষুধগুলো বৃষ্টির পানির সাথে নদী ও সাগরে গিয়ে পড়ে এবং জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর দেহে জমা হয়। এতে জলজ জীবের ক্ষতিসাধন হয়।
৩। এসিডসমূহঃ খনি হতে নির্গত এসিডসমূহ পানিতে মিশে এসিডের হার বৃদ্ধি করে থাকে। পানিতে এসিডের পরিমাণ অধিক মাত্রায় বৃদ্ধি পেলে জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর জন্য তা হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।
৪। নর্দমার ময়লাঃ নদী বা কূপ হতে আমরা খাওয়ার পানি সরবরাহ করে থাকি। এগুলো সাধারণত নর্দমার ময়লা দ্বারা দূষিত হয়। শহরাঞ্চলের নর্দমাগুলো সাধারণত নদীতে গিয়ে শেষ হয়। এগুলো দ্বারা মানুষ ও অন্যান্য পশুর মল, অথবা ফেলে দেওয়া বা নষ্ট হয়ে যাওয়া খাদ্যদ্রব্য ইত্যাদি নদীতে পতিত হলে এগুলো ব্যাকটেরিয়ার প্রভাবে অজৈব পদার্থের রূপান্তরিত হয়। ব্যাকটেরিয়াসমূহের এ ধরনের কার্যবলির জন্য প্রচুর অক্সিজেন খরচ হয়। ফলে পানি দূষিত হয় এবং তা ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে। যেমন - ঢাকার নর্দমার ময়লার মাধ্যমে বুড়িগঙ্গার পানি দূষণ।
আরো পড়ুন: বায়ু দূষণের ১০টি কারণ
৫। শিল্পের আবর্জনাঃ শিল্পবিল্পবের শুরু থেকেই শিল্পসমূহ হতে নির্গত ময়লা ও আবর্জনা নদী ও সমুদ্রের পানি দূষিত হওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। কাগজ ও কাগজমন্ড, বস্ত্র, চিনি, সার, লৌহ জাতীয় ধাতু, চামড়া ও রাবার, ওষুধ ও রাসায়নিক শিল্প-কারখানা হতে নির্গত আবর্জনাসমূহ বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান গঠিত। এগুলো পানিতে মিশে পানিকে দূষিত করে। যেমন - নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্য নদীর পানি দূষণ।
৬। কঠিন আবর্জনাঃ প্লাস্টিক, পলিথিন, রাবার, অ্যাসবেস্টস ইত্যাদি দ্বারা পরিবেশ দূষিত হয়। এসব পদার্থ দ্বারা তৈরি দ্রব্যাদি সহজে নষ্ট হয় না এবং সহজে তার রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে না। ব্যাকটেরিয়া ও অন্যান্য অণুজীব এর উপর কোনো বিক্রিয়া করতে পারে না। তাই এসব পদার্থগুলো পানিতে পড়ে পানি দূ্ষিত করে।
পানি দূষণ রোধের উপায়
১। কীটনাশক ও স্যারের নিয়ন্ত্রণঃ কীটনাশক, ছত্রাকনাশক, আগাছানাশক ও রাসায়নিক সারের ব্যবহার সীমিত রাখা এবং এদের ব্যবহারে প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। এর বিকল্প হিসেবে জৈব সার ও প্রাকৃতিক কীটনাশকের ব্যবহার বাড়াতে হবে।
২। তেল নিষ্কাশন নিয়ন্ত্রণঃ পানিতে তেল নিষ্কাশন বন্ধ করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া।
৩। জলাশয়ে গোসল ও কাপড়কাঁচা বন্ধ রাখাঃ পুকুরসহ অন্যান্য আবদ্ধ জলাশয়ে গোসল ও কাপড়কাঁচা নিষদ্ধ করতে হবে।
৪। কচুরিপানা ও শৈবাল নিয়ন্ত্রণঃ জলাশয়, খাল-বিল যাতে কচুরিপানা ও ভাসমান শৈবালে ভরে না যায়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
৫। খনিজ পদার্থের নিয়ন্ত্রণঃ খনিজ বর্জ্য যাতে নদী ও সমুদ্রের পানিতে শোধনপূর্ব নির্গত হয়, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
৬। বিষাক্ত বর্জ্য নিয়ন্ত্রণঃ শিল্প কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য, নদী-নালা ও অন্যান্য জলাশয়ে না ফেলা।
৭। বর্জ্য ও আবর্জনা শোধনঃ
i. শিল্প-কারখানার দূষিত অপ্রয়োজনীয় তরল বর্জ্য যথাযথভাবে শোধনপূর্ব নদী-বানাতে নিক্ষেপ করতে হবে।
ii. পয়ঃপ্রণালী ও গৃহস্থলির আবর্জনা ও ময়লা জলাশয়ে নিষ্কাশনের পূর্বে যথাযথভাবে শোধন করা।
iii. পয়ঃপ্রণালী বাহিত আবর্জনাগুলোকে নদীতে নিক্ষেপ করার পূর্বে ফিল্টার ট্যাংক বা জারণ ট্যাংক এর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করতে হবে।
iv. ফিল্পার ও জারণ ট্যাংকগুলোতে বিয়োজক অণুজীব রেখে পয়ঃপ্রণালী বাহিত জৈব আবর্জনাগুলোকে এমনভাবে পরিবর্তিত করতে হবে, যাতে তারা ক্ষতিকর অবস্থায় না থাকে।
৮। আইন প্রয়োগঃ পরিবেশ বিষয়ক কঠোর আইন প্রণয়ন করা ও তার প্রয়োগ নিশ্চিত করা দরকার। ইউরোপীয় দেশগুলোতে পানিদূষণের পানিদূষণের বিরুদ্ধে কঠোর আইন রয়েছে। যেমন: জলজ যানবাহনের তেল, ময়লা আবর্জনা প্রভৃতি থেকে যেন পানি দূষিত না হয়, তার ব্যবস্থা জলযানকে নিতে হয়, না নিলে কঠোর শাস্তি বা জরিমানা দিতে হয়।
আরো পড়ুন: মাটি দূষণের কারণ ও প্রতিকার
৯। কূটনৈতিকভাবে নদীতে পানি প্রবাহের সুষ্ঠু বল্টন: নদীতে পানি প্রবাহ কম থাকলে এতে পলি জমে নদীর গভীরতা কমে যায়। কমে বর্জ্য, আবর্জনা দ্রুত স্থানান্তর না হতে পেরে পানি দূষণের সৃষ্টি হয় ও বন্যার প্রকোপ ঘটে। বাংলাদেশের পদ্মা নদীমুখে ভারতের দেওয়া ফারাক্কাসহ বিভিন্ন বাঁধের ফলে দেশের নদীগুলোর অবস্থা বর্তমানে সংকটাপন্ন। তাই কূটনৈতিক ও আন্তর্জাতিকভাবে আলোচনা ও চাপ সৃষ্টি করে প্রতিবেশি দেশের সাথে এ সমস্যার সমাধান করতে হবে।
১০। গণসচেতনতা বৃদ্ধিঃ স্কুল-কলেজে পানি দূষণ সম্পর্কিত শিক্ষা এবং রেডিও, টেলিভিশন ও পত্রিকার মাধ্যমে ব্যাপক হারে গণসচেতনতা সৃষ্টি করার মাধ্যমে পানি দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url