হরমোন কি? হরমোনের সংজ্ঞা জেনে নিন

হরমোন কি? হরমোনের সংজ্ঞা

১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে এডওয়ার্ড সারপে স্যাফার এবং অলিভার হোমস্ হরমোনের উপস্থিতি সম্পর্কে ধারণা দান করেন কিন্তু বাইলিস এবং স্যার স্টারলিং (১৯০২-১৯০৫) প্রথম সিক্রিটিন সম্পর্কে প্রকৃত ধারণা দেন এবং ‘হরমোন’ শব্দের প্রয়োগ করেন। হরমোন শব্দটি গ্রিক শব্দ hormao বা hermin থেকে উদ্ভূত, এর অর্থ to impel বা I rouse I excite অর্থাৎ উত্তেজিত করা। হরমোন এবং অন্তঃক্ষরাগ্রন্থি সম্পর্কিত জ্ঞানচর্চার বিষয়কে এন্ডোক্রিনোলোজি বলে। বিভিন্ন লেখক হরমোনকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। যেমনঃ
হরমোন কি? হরমোনের সংজ্ঞা জেনে নিন
Guyton - এর মতে, ‘‘হরমোন হচ্ছে সেই বিশেষ ধরনের রাসায়নিক বস্তু যা দেহস্থ তরলে (রক্ত অথবা কলারসে) কোন কোষ অথবা কোষগুচ্ছ বা নালীহীন গ্রন্থি দ্বারা নিঃসৃত হয় এবং অন্যান্য কোষ তথা অঙ্গের বা দেহের শারীরবৃত্তীয় কর্মৎপরতা নিয়ন্ত্রণ করে’’

Harper - এর মতে, ‘‘হরমোন হচ্ছে সেই কোষ সংশ্লেষিত রাসায়নিক বস্তু যা রক্তে বা সংবহনতন্ত্রে ক্ষরিত হয় এবং বাহিত হয়ে দূরবর্তী কর্মস্থলে বিষ্ময়কর ক্রিয়া সাধন করে।’’ অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি বা নালীবিহীন গ্রন্থিজাত যেসব রাসায়নিক বস্তু দেহরস অথবা রক্তস্রোতে নিঃসৃত হয় এবং রক্ত দ্বারা পরিবাহিত হয়ে দূরবর্তী কর্মস্থলে ক্রিয়াশীল হয় এবং দেহের বিভিন্ন মৌলিক ক্রিয়া, যেমন: বিপাক, বৃদ্ধি প্রভৃতি তথা কিছু গৌণ বৈশিষ্ট্যের বিকাশ নিয়ন্ত্রণ করে তাদের হরমোন বলে। হরমোন দেহস্থ তরলে সহজে দ্রবণীয় এবং সহজ ব্যাপনযোগ্য কিন্তু অ্যান্টিজেনধর্মী নয় এবং কর্মসম্পাদন শেষে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। কোন হরমোন কেবল শারীরবৃত্তীয় কর্মতৎপরতায় উদ্দীপনেই যোগায় না, কখনও কখনও কর্মতৎপরতার অবদমনও করে।

হরমোনের বৈশিষ্ট্য

১। হরমোন অবশ্যই নালীবিহীন গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হয় এবং দেহরস অথবা রক্তে পরিবাহিত হয়। এরা ক্ষরণস্থল থেকে দেহের দূরবর্তী স্থানে প্রভাব বিস্তার করে।

২। হরমোনসমূহ অতি ক্ষুদ্রকায় ও সহজ দ্রবণীয় অণু তাই সহজে কোষ আবরণী অথবা রক্তনালী আবরণী ভেদ করতে পারে।

৩। প্রতিটি হরমোন কর্মতৎপরতায় সুনির্দিষ্ট ফলে নির্দিষ্ট অঙ্গ অথবা নির্দিষ্ট ক্রিয়ার উপর প্রভাব বিস্তার করে এবং নির্দিষ্ট পরিবর্তন ঘটায়।

৪। হরমোনের কর্মসম্পাদনের জন্য অতিঅল্প বা সামান্য পরিমাণই যথেষ্ট। ঐ সামান্য পরিমাণই বিষ্ময়কর কর্মসম্পাদন করে।

৫। কর্মসম্পাদনের পর পর বা কর্মতৎপরতার প্রভাবে হরমোন বিনষ্ট হয় সুতারাং সক্রিয়তা বা কর্মহারের নিরবচ্ছিন্নতা রক্ষার্থে সংশ্লিষ্ট গ্রন্থি অবিরত হরমোনের নিঃসরণ করে।

৬। হরমোন তার নিয়ন্ত্রণাধীন কোন কোষীয় বিক্রিয়ার সূত্রপাত করে না কেবল বিক্রিয়াকে উদ্বুদ্ধ করে।

৭। অধিকাংশ হরমোনের কর্মতৎপরতা বিভিন্ন প্রাণীর ক্ষেত্রে একই রকম।

বিভিন্ন প্রাণীর ক্ষেত্রে হরমোনসমূহ গ্যামেটোজেনেসিস, জনননালীর রক্ষণাবেক্ষণ, আনুষঙ্গিক ও গৌনজনন বৈশিষ্ট্য করে। এরা বিপাকক্রিয়া এবং ক্রিয়া-বিক্রিয়া সংশ্লিষ্ট এনজাইম ক্ষরণ, পানি ও আয়ন সাম্যতা, রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ প্রভৃতি নির্ধারণসহ স্থিতিসাম্যতা নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়াও হরমোন অভিযোজনিক প্রক্রিয়াও নিয়ন্ত্রণ করে।

হরমোনের শ্রেণীবিভাগ

গাইটন এবং হল হরমোনকে প্রধানত দুই শ্রেণীতে ভাগ করেছেন। যথাঃ (১) স্থানীয় হরমোন ও (২) সাধারণ হরমোন।

স্থানীয় হরমোনঃ যেসব হরমোন নির্দিষ্ট অঞ্চলে ক্ষরিত হয় এবং সম্পূর্ণরূপে ঐ অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ থাকে তাদেরকে এই শ্রেণীভুক্ত করা হয়, যেমন- সিক্রিটিন ডিওডেনামের প্রাচীর থেকে নিঃসৃত হয়ে পাকস্থলী, অগ্ন্যাশয় রসের ক্রিয়াশীলতা নিয়ন্ত্রণ করে। কোলোসিস্টোকাইনিন, গ্যাস্ট্রিন, এন্টোরোগ্যাস্ট্রন, অ্যাঞ্জিওস্টেনিন প্রভৃতি হরমোন পৌষ্টিকনালীর কর্মতৎপরতা নিয়ন্ত্রণ করে।

সাধারণ বা সার্বিক হরমোনঃ অধিকাংশ সার্বিক হরমোন নির্দিষ্ট বা বিশেষায়িত অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হয়, যেমন - ইপিনেফ্রিন অ্যাড্রিন্যাল মেডালা থেকে নিঃসৃত হয় এবং প্রধানত রক্ত বাহিকার সংকোচন প্রসারণসহ ধমনী রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে। কিছু সংখ্যক সাধারণ হরমোন দেহের সমগ্রকোষের উপর প্রভাব বিস্তার করে, যেমন - বৃদ্ধির হরমোন পিটুইটারি গ্রন্থির অগ্রাঞ্চল থেকে নিঃসৃত হয়ে দেহের বিভিন্ন অংশ ও অঙ্গের নির্দিষ্ট পরিমাণ বৃদ্ধি প্রভাবিত করে। থাইরয়েড হরমোন থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হয় অথচ দেহের অধিকাংশ কোষস্থ রাসায়নিক বিক্রিয়াসমূহ নিয়ন্ত্রণ করে। 
কিছু সংখ্যক হরমোন কেবল নির্দিষ্ট বা বিশেষ অঙ্গেই ক্রিয়াশীল হয়। ঐ অঙ্গগুলোকে টার্গেট টিস্যু বলে। কারণ ঐসব অঙ্গে ঐ নির্দিষ্ট হরমোন আবদ্ধ বা ক্রিয়াশীল হওয়ার জন্য বিশেষ ধরনের টার্গেট কোষ বা গ্রাহক থাকে, যেমন - অ্যাড্রিনোকার্টিকেট্রফিক হরমোন কেবল অ্যাড্রিন্যাল কর্টেক্সকে উদ্বুদ্ধ করে। ডিম্বাশয় নিঃসৃত হরমোন স্ত্রীজনন অঙ্গ এবং স্ত্রী প্রজাতিগত আনুষঙ্গিক গৌণ বৈশিষ্ট্যের উদ্রেক ঘটায়। এই হরমোনদলকে ট্রপিক হরমোনও বলা হয়। এদের কর্মসম্পাদনগত পার্থক্য থাকলেও এরা সকলেই সাধারণ হরমোনের শ্রেণীভুক্ত এবং নিঃসরণ উৎস থেকে দূরবর্তী টার্গেটস্থানে ক্রিয়াশীল হয়।

রাসায়নিক গঠন অনুসারে হরমোনকে চার শ্রেণীতে ভাগ করা হয়।

ক) প্রোটিন বা প্রোটিন উদ্ভূত বা অ্যামাইনো এসিডজাত হরমোনঃ অগ্ন্যাশয় ও অগ্রপিটুিইটারি হরমোনসমূহ প্রোটিন হরমোন। পশ্চাৎ পিটুইটারি হরমোনসমূহ পেপটাইডজাত হরমোন।

খ) স্টেরয়েড হরমোনঃ গোনাড নিঃসৃত হরমোনসমূহ।

গ) ক্যাটেকোলামাইনঃ অ্যাড্রিনালিন ও নরঅ্যাড্রিনালিন।

ঘ) আয়োডোথাইরোনিন: T4 এবং T3।

হরমোনের রাসায়নিক গঠন

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে রাসায়নিক গঠন অনুসারে হরমোন ৪ ধরনের। এদের মধ্যে স্টেরয়েড হরমোনগুলো স্টেরয়েড নিউক্লিয়াসের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং কোলেস্টেরলজাত। এদের গঠন কাঠামো প্রধানত কোলেস্টেরলের অনুরূপ সাইক্লোপেন্টানো-পারহাইড্রো-ফিনেনথ্রিন নিউক্লিয়াসের উপর প্রতিষ্ঠিত। কেবল এদের মিথাইল মূলকের অবস্থান ও সংযোজনের পার্থক্যের দরুন এরা ভিন্ন ভিন্ন কর্মসম্পাদন করে। অ্যাড্রিন্যাল কর্টেক্স নিঃসৃত কর্টিসল, অ্যান্ডোস্টেরন, ডিম্বাশয় নিঃসৃত এস্টোজেন, প্রোজেস্টেরন, শুক্রাশয় নিঃসৃত টেস্টোস্টেরন এবং অমরা নিঃসৃত হরমোনসমূহ এই ধরনের। এসব হরমোন লিপিড দ্রাবকে দ্রবণীয় এবং স্টেরয়েড যৌগ।

ইপিনেফ্রিন এবং নর ইপিনেফ্রিন অ্যাড্রিন্যালমেডালা নিঃসৃত হরমোন টাইরোসিন উপজাত অ্যামাইনো এসিড ক্যাটেকোলামাইন দ্বারা গঠিত। থাইরক্সিন এবং ট্রাইআয়োডো-থাইরোনিন বিপাকীয় হরমোনদ্বয় টাইরোসিন নামক অ্যামাইনো এসিডের আয়োডিনজাত অবস্থার রূপ। উল্লেখিত হরমোনগুলো ব্যতিত বাকি হরমোন প্রোটিন, পেপটাইড অথবা উদ্ভূত প্রোটিন নির্মিত। অগ্র পিটুইটারী হরমোনগুলোর কিছুসংখ্যক প্রোটিন এবং বাকিগুলো বৃহৎ পলিপেপটাইড। পশ্চাদ পিটুইটারি হরমোন, যেমন - অক্সিটোসিন, ভেসোপ্রেসিন এবং অ্যান্টিডাইয়্যুরেটিক হরমোন অ্যামাইনো এসিডবিশিষ্ট পলিপেটাইড। ইনসুলিন, গ্লুকাগন, প্যারাথরমোন প্রভৃতি বৃহৎ পলিপেপটাইড নির্মিত হরমোন। এসব হরমোনের রাসায়নিক সংকেত পরবর্তীতে সংযোজিত হয়েছে।

হরমোন সংশ্লেষ

হরমোনের রাসায়নিক গঠনকাঠামো প্রধানত তিন ধরনের। নির্দিষ্ট উৎসে নির্দিষ্ট ধরনের হরমোন সংশ্লেষিত হয় এবং তিন ধরনের রাসায়নিক গঠনসম্পন্ন হওয়ায় তিন উপায়ে হরমোনের সংশ্লেষ ঘটে। সুতারাং তিনটি দৃষ্টান্তের মাধ্যমে তিনটি উৎসে তিন ধরনের হরমোনের জৈব সংশ্লেষ বর্ণনা করা হলোঃ

১। পেপটাইড হরমোন সংশ্লেষঃ পেপটাইড অথবা পেপটাইডজাত হরমোনের সংশ্লেষ প্রক্রিয়া প্রোটিন সংশ্লেষের অনুরূপ। সুতরাং এক্ষেত্রে DNA থেকে RNA প্রতিলিপন ঘটে এবং যুগপৎ তার সদৃশ হরমোনও সংশ্লেষিত হয়। ইনসুলিন একটি পেপটাইড হরমোন। প্রোটিন সংশ্লেষের সময় mRNA ও tRNA যে কৌশলে অ্যামাইনো এসিড ভাণ্ডার থেকে অ্যামাইনো এসিড গ্রহণ করে পলিপেপটাইড শৃঙ্খল তৈরি করে, এখানেও অনুরূপ কর্ম হুবহু সম্পাদিত হওয়ায় অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিকোষে প্রথমে পেপটাইড শৃঙ্খল তৈরি হয়। এর পরবর্তী ধাপগুলো পর্যায়ক্রমে বর্ণনা করা হলোঃ
  • অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিকোষে প্রোটিন সংশ্লেষ অনুরূপ পদ্ধতিতে প্রথম অতি দীর্ঘকায় যে পেপটাইড শৃঙ্খল উৎপন্ন হয় তাকে সাধারণভাবে প্রিপ্রোহরমোন এবং ইনসুলিনের ক্ষেত্রে প্রিপ্রোইনসুলিন বলে।
  • প্রিপ্রোইনসুলিন বা প্রিপ্রোহরমোন হচ্ছে হরমোনের আদি বস্তু। এর পরবর্তী ধাপে প্রোইনসুলিন বা প্রোহরমোন উৎপাদিত হয়। যখন পলিপেপটাইড শৃঙ্খলে প্রোইনসুলিন বা প্রোহরমোন আবদ্ধ থাকে তখন একে সিগন্যাল সিকুয়েন্স বলে এবং প্রিপ্রোইনসুলিন থেকে থেকে সিগন্যাল সিকুয়েন্স অপসারিত হলে প্রোইনসুলিনে রূপান্তরিত হয়। অর্থাৎ র্দীকায় পলিপেপটাইড শৃঙ্খলে যখন প্রোইনসুলিন সংযুক্ত অবস্থায় থাকে তখন সমষ্টিগতভাবে প্রিপ্রোহরমোন বা প্রিপ্রোইনসুলিন বলে। প্রিপ্রোইনসুলিনের সিগন্যাল সিকুয়েন্স 23 অ্যামাইনো এসিডবিশিষ্ট পলিপেপটাইড। প্রিপ্রোইনসুলিন প্রথম অগ্ন্যাশয়ের আইলেটস অব ল্যাঙ্গারহ্যান্সের B কোষে সংশ্লেষিত হয় এবং B কোষের এণ্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামের ঝুলন্ত রাইবোজামে উৎপন্ন হয়।
  • প্রিপ্রোইনসুলিন শৃ্ঙ্খলে সিগন্যাল সিকুয়েন্স আবদ্ধ থাকে যা এনজাইমের ক্রিয়ার শৃঙ্খল থেকে বিচ্যুত বা অপসারিত হয়ে প্রোইনসুলিন গঠন করে।
  • মানুষের ক্ষেত্রে প্রোইনসুলিনের মস্তকে বা মস্তক প্রান্তে A পুচ্ছ প্রান্তে B এবং A ও B এর সংযোজক C পেপটাইড থাকে, এরা সমষ্টিগতভাবে একটি একশৃঙ্খলী পলিপেপটাইড। একটি পূর্ণাঙ্গ মানব প্রোইনসুলিনে 86টি অ্যামাইনো এসিড থাকে, তন্মোধ্য A অংশে 21 এবং B অংশে 30 অ্যামাইনো এসিড থাকে।
  • মানুষের ক্ষেত্রে প্রোইনসুলিনের 86 অ্যামাইনো এসিড বিন্যাসে B (30 অ্যামাইনো এসিড) আর্জিনিন-আর্জিনিন, C পেপটাইড ( 31 অ্যামাইনো এসিড) লাইসিন-আর্জিনিন শৃঙ্খল এবং A ( 21 অ্যামাইনো এডিস) = 86 অ্যামাইনো এসিড। এই প্রোইনসুলিন থেকে থায়ল সক্রিয় প্রোটিয়েজ ( thiol activated protease) এবং প্লাজমিনোজেন সক্রিয়ক এনজাইমের ক্রিয়ায় C পেপটাইড এবং তৎসহ 4 টি অ্যামাইনো এসিড কর্তিত হয়। অর্থাৎ [86-(31+4)] অ্যামাইনো এসিড প্রোইনসুলিন থেকে অবশেষীয় হিসেবে থেকে যায়।
২। স্টেরয়েড হরমোন সংশ্লেষঃ স্বাভাবিক অবস্থায় বৃক্ক এবং গোনাড নিঃসৃত হরমোনসমূহ স্টেরয়েড শ্রেণীভুক্ত। এখানে বৃক্কের হরমোন সংশ্লেষ প্রক্রিয়া বর্ণনা করা হলোঃ বৃক্কের সুপ্রারিন্যাল কর্টেক্সের জোনা গ্লোমারিউলোসা অথবা জোনা ফ্যাসিকুলাটা কোষগুচ্ছকে হরমোন সংশ্লেষী কোষ উল্লেখ্য যে, সংশ্লেষের পূর্বেই কোলেস্টেরল সংশ্লেষিত হয় এবং পরে কোলেস্টেরল ধাপে ধাপে হরমোন উৎপাদন করে।
  • হরমোন সংশ্লেষী কোষের LDL অণু প্রথমে LDL গ্রাহকের সাথে সংযুক্ত হয়। এরপর LDL কোলেস্টেরল যৌগ কোষপর্দা ভেদ্যতা বৈশিষ্ট্য অর্জন করে এবং কোষপর্দা ভেদ করে কোষ অভ্যন্তরে স্টেরয়েড হরমোন সংশ্লেষ বা স্টেরয়ডোজেনেসিস পথে প্রবেশ করে।
  • স্টেরয়ডোজেনেসিসের মাধ্যমে তিন পথে (Pathway) কর্টিসল, অ্যালডোস্টেরন, অ্যান্ড্রোস্টেনেডিওন উৎপাদিত হয়।
  • অ্যাসিটেট বা কোলেস্টেরল থেকে স্টেরয়েড হরমোনের জৈব সংশ্লেষ শুরু হয়। সেই অর্থে কোলেস্টেরলকে সংশ্লেষের প্রারম্ভিক বিন্দু হিসেবে যদি বিবেচনা করা হয় তবে অ্যাড্রিনোকর্টিক্যাল কোষে পর্যাপ্ত কোলেস্টেরল থাকে। এই কোলেস্টেরল সুপ্রারিন্যাল কোষগুচ্ছ দুটি উৎস থেকে সংশ্লেষ করে, যথা: এর সরল পূর্বজ যৌগ অ্যাসিটেট থেকে অথবা প্লাজমা থেকে উৎপাদিত হয়।
  • কর্টিক্যাল কোষের অভ্যন্তরে প্রথমে ডেসমোলেজ এনজাইমের প্রভাবে কোলেস্টেরল 21 কার্বন যৌগ প্রেগনেনোলন উৎপন্ন করে। একে হার নিয়ন্ত্রণ ধাপ বলে। পরবর্তী পর্যায়ে তিনটি এনজাইম সংস্থা 11 - B, 17 - a এবং 21হাইড্রক্সিলেজ তিন পথে উল্লিখিত ধরনের হরমোনের উৎপাদন করে।
  • ক) প্রেগনেনোলন - প্রোজেস্টেরন - ডিঅক্সিকর্টিকোস্টেরন - কর্টিকোস্টেরন - অ্যালডোস্টেরন (লাইন-A)
  • খ) প্রেগনেনোলন - 17 হাইড্রক্সি প্রেগনেনোলন - 17 হাইড্রক্সি প্রজেস্টেরন - 11 ডি অক্সি কর্টিসল - কর্টিসল ( লাইন - B)
  • গ) প্রেগনেনোলন - 17 হাইড্রক্সিপ্রেগনেনোলন - ডি হাইড্রো-ইপি অ্যান্ড্রোস্টেরন - অ্যান্ড্রোস্টেনেডিওন। ( লাইন - C )
৩। অ্যামাইনো এসিড টাইরোসিনজাত হরমোনের সংশ্লেষঃ থাইরক্সিন, ট্রাই আয়োডোথাইরোনিন, ইপিনেফ্রিন, নরইপিনেফ্রিম প্রভৃতি টাইরোসিন উদ্ভূত হরমোন। থাইরক্সিন এবং ট্রাই আয়োডোথাইরোনিন হরমোনদ্বয় থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হয়। এখানে উল্লিখিত হরমোনদ্বয়ের প্রক্রিয়া আলোচনা করা হলোঃ

থাইরয়েড গ্রন্থি অসংখ্য ফলিকল নির্মিত এবং ফলিকলগুলো বদ্ধ ধরনের। এই ফলিকলগুলো বিশেষ ধরনের নিঃস্রাবী কিউবয়ডাল ইপিথেলিয়াম আবৃত। ফলিকলের কিউরয়ডাল আবরণী যে নিঃসরণ দেয় সেগুলোই ফলিকলের অভ্যন্তরে জমা থাকে এবং সঞ্চিত বস্তুগুলোই নিঃসরণ আকারে ইপিথেলিয়াম ভেদ করে রক্তে স্রোতে গমন করে। থাইরয়েড গ্রন্থির অভ্যন্তরে বা গ্রন্থিতে রক্ত সরবরাহে বিশেষত্ব বিদ্যমান। প্রতি মিনিটে গ্রন্থির ওজনের প্রায় পাঁচ গুন রক্ত গ্রন্থিতলে প্রবাহিত হয়। 
থাইরক্সিন ও ট্রাই আয়োডোথাইরোনিন মূলত বিপাকীয় হরমোন এবং বিপাকীয় ক্রিয়ায় ব্যবহৃত উল্লিখিত হরমোনদ্বয়ের 93% থাইরক্সিন এবং 7% ট্রাই আয়োডোথাইরোনিন। কিন্তু কর্মস্থলে ব্যবহৃত হওয়ার সময় অধিকাংশ থাইরক্সিনই ট্রাই আয়োডোথাইরোনিনে রূপান্তরিত হয়। যদিও কর্মতৎপরতা, কর্মকৌশল, বৈশিষ্ট্য উভয় হরমোন প্রায় একই ধরনের কিন্তু ক্রিয়ার তীব্রতা, কর্মসম্পাদনের শক্তিমানে ট্রাই আয়োডোথাইরোনিন থাইরক্সিনের চেয়ে প্রায় চার গুন শক্তিশালী।

হরমোনের ক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ

দেহের অন্তঃস্থ স্থিতিসাম্যতা অর্জনের কয়েকটি প্রধান উপাদানের মধ্যে হরমোন একটি। সেজন্য রক্তে বিমুক্ত হরমোনের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ থাকাও বিশেষভাবে প্রয়োজন। অধিক পরিমাণ হরমোন যেমন দেহের স্থিতিসাম্যতা নষ্ট করে তেমনই কম পরিমাণও দেহের জন্য ক্ষতিকর। সুতরাং ফিডব্যাক কৌশলে হরমোনের ক্ষরণ নিয়ন্ত্রিত হয় সেই সাথে দেহস্থঃ অন্তঃক্ষরা গ্রন্তিগুলোর নিঃসরণও নিয়ন্ত্রিত হয়। হরমোনের ক্ষরণ নিয়ন্ত্রকারী ৪ টি উপাদান নিম্নরূপঃ

১। অগ্রপিটুইটারীঃ অগ্রপিটুইটারী নিঃসৃত হরমোনসমূহ সহজাত গুণেই দেহের অন্যান্য প্রধান অন্তঃক্ষরাগ্রন্থিগুলোর ক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ করে, যেমন: থাইরোট্রপিক, গোনাডোট্রপিক, অ্যাড্রিনোকর্টিকোট্রপিক প্রভৃতি হরমোনসমূহ যথাক্রমে থাইরয়েড, গোনাড ও অ্যাড্রিন্যাল গ্রন্থির ক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ করে। তবে নিগেটিভ ফিডব্যাক কৌশল বিভিন্ন গ্রন্থির ক্ষরণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

২। হাইপোথ্যালামাসঃ হাইপোথ্যালামাস ও অগ্রপিটুইটারীর মধ্যে বাহিকা বা পোর্টালতন্ত্র সংযোগ বিদ্যমান। হাইপোথ্যালামাস বিমুক্ত হরমোনগুলোকে উদ্দীপক উপদান বলা হয়। এরা কেবল স্থানীয়ভাবে অগ্রপিটুইটারীকেই উদ্দীপ্ত করে। TRH, সোমাটোস্টেটিন এবং ডোপামিন প্রভৃতি হরমোনের সাহায্যে অগ্রপিটুইটারীকে সুনির্দিষ্ট হরমোন বিমুক্ত করার উদ্দীপনা যোগায়। ফলে উল্লেখিত হরমোনগুলোকে বিমুক্তি উপাদান বলে। এক কথায় হাইপোথ্যালামাস অগ্রপিটুইটারীর ক্ষরণ নিয়ন্ত্রক।

৩। সারকাডিয়ান ছন্দবদ্ধতাঃ অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রে কিছু অন্তঃক্ষরা ক্ষরণ বিশেষত্ব কর্টিসল এবং ACTH দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে প্রচণ্ড শক্তিতে ক্ষরিত হয় ঠিক বিপরীতক্রমে রাতের নির্দিষ্ট সময়ে ক্ষরণ অতিমাত্রায় হ্রাস পায় বা ক্ষরণ হয় না। দিবারাত্রি চক্রের প্রভাবে এই ঘটনা বার বার একই ছন্দে পুনরাবৃত্ত হয়। একে সারকাডিয়ান ছন্দবদ্ধতা বলে।

৪। পীড়নঃ দেহের স্থিতিসাম্যতার বিরোধী যে কোন উদ্দীপনাই পীড়ন হিসেবে পরিচালিত। শারীরিক ক্ষত, মানসিক ক্ষত, দুশ্চিন্তা, ভয়, আবেগ, অসুস্থতা ইত্যাদি নেই কারণ দেহের অভ্যন্তরস্থ পরিবেশে পীড়নের উদ্ভব হয়। এই পীড়নের প্রভাবে বিশেষ হরমোন, যেমন- ACTH, কর্টিসল, ADH, থাইরক্সিন প্রভৃতির ক্ষরণ বৃদ্ধি পায়।

উপসংহার

প্রিয় পাঠক, আজকে আমি আপনাদের সাথে হরমোন কি? হরমোনের সংজ্ঞা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। আশা করি আপনি এই পোস্টটি পুরো মনোযোগ সহকারে পড়েছেন এবং উপকৃত হতে পেরেছেন। এ রকম আরো তথ্যমূলক পোস্ট পড়তে আমাদের সাথেই থাকুন। আমরা সবসময় পাঠকের চাহিদা অনুযায়ী পোস্ট পাবলিশ করে থাকি। এই পোস্টটি পুরো মনোযোগ সহকারে পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url